করোনাকালে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় বাল্যবিয়ের হিড়িক পড়েছে। গত ১০ মাসে উপজেলার একটি মাদ্রাসার ৭৪ ছাত্রীই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে।
ব্রহ্মপুত্রের নজিরবিহীন ভাঙনের শিকার চিলমারীতে দারিদ্র্য এখনও প্রকট। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের তিনটি ইতোমধ্যে নদীভাঙনে কার্যত বিলীন হয়ে গেছে। বাকি তিনটিরও অর্ধেক গ্রাস করেছে প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র। দারিদ্র্য ও মোবাইল ফোনে প্রেমকেই বাল্যবিয়ের জন্য দায়ী করছেন স্থানীয়রা। মেয়েদের পাশাপাশি স্কুলপড়ূয়া অনেক ছেলেও করোনাকালে বিয়ে করে ফেলেছে।
উপজেলার অষ্টমীরচর, নয়ারহাট ও চিলমারী ইউনিয়ন তিনটি ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা চরাঞ্চলের সমষ্টি। নদীভাঙনে পুরোপুরি বিলীন হয়নি রমনা, থানাহাট ও রানীগঞ্জ ইউনিয়ন। রমনা ইউনিয়নের একটি স্বনামধন্য মাদ্রাসা হলো পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসার সুপার আব্দুল আজিজ আকন্দ সমকালকে জানান, ২০২১ সালে তার মাদ্রাসার মোট ৭৪ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। গত ১৪ নভেম্বর এক চিঠিতে তিনি সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাদের নামের তালিকাও দিয়েছেন।
এদিকে স্থানীয় প্রশাসন সম্প্রতি চিলমারীর ৩টি ইউনিয়নকে প্রাথমিকভাবে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা দিয়েছে। এর একটি চিলমারী ইউনিয়ন। সম্প্রতি দুর্গম এ ইউনিয়নে সরেজমিন গিয়ে বাল্যবিয়ের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। এ ইউনিয়নের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কড়াই বরিশাল নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে গিয়ে জানা গেছে, করোনাকালে চলতি বছরেই দারিদ্র্যের কারণে স্কুলটির অষ্টম শ্রেণির আরবিনা, তাহমিনা, লাভলী, নুরমনি ও ছুমাইয়া এবং সপ্তম শ্রেণির ঝর্ণা, আশুরা, মল্লিকা, কুলছুমসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।
অষ্টমীরচর ইউনিয়নের নটারকান্দি গ্রামের আরদোশ আলীর মাধ্যমিক স্কুলপড়ূয়া কন্যা আর্জিনা আক্তার নটারকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। সম্প্রতি তার বিয়ে হয়ে গেছে। কেন এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করলে জানতে চাইলে সে বলেছে, ‘বাজান আমার বিয়া ঠিক করলে তারে বাধা দিলাম। কইলাম, বাজান আমি অহনই বিয়া করুম না, লেখাপড়া করুম। বাজান হুনলো না। কইলো বেকার বাড়িতে তোরে বইয়া বইয়া আমি পালতে পারমু না। ভালা ছেলে পাইছি। হেরপর আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়া দিয়া দিছে। বাজানের মুকের দিকে তাকাইয়া রাজি হইলাম।’
এই স্কুলের মো. আলামিন, সানোয়ার ইসলাম, বাবলুসহ আরও কয়েকজন ছেলের বিয়ে হয়েছে করোনাকালে। এ স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রী আমিনা, ঝর্ণা, ইয়াসমিন, বিউটি, সুমি, রুবিনা, মিনারাসহ বেশ কিছু মেয়েরও বিয়ে হয়েছে। নটারকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শুকুর মাহমুদ জানান, করোনাকালে তার স্কুলের ৩০ থেকে ৪০ জন ছাত্রী ও ৭ থেকে ৮ জন ছাত্রের বিয়ে হয়ে গেছে। এসব বাল্যবিয়ের জন্য তিনি দারিদ্র্য ও মোবাইল ফোনে প্রেমকে দায়ী করেন।
নয়ারহাট ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষিণ খাউরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনাকালে এখানকার নবম শ্রেণির ছাত্রী স্মৃতি, কবিতা, সুমনা ও রুমানার বিয়ে হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার্থী জেসমিনেরও বিয়ে হয়েছে সম্প্রতি। এই স্কুলের শিক্ষার্থী হাফিজুর ও অঞ্জলীর বিয়ে হয়েছে মোবাইলে প্রেমের মাধ্যমে। তারাও এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী।
অবশ্য বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত চিলমারী উপজেলায় বাল্যবিয়ে হয়েছে ১৩৮টি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে ৭০টি।
সরেজমিনে এই প্রতিবেদনের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। শিক্ষকের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে নটারকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪০ জনের বেশি, দক্ষিণ খাউরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে শুধু নবম ও দশম শ্রেণির ২০ জনের অধিক ছাত্রছাত্রী এবং চিলমারী ইউনিয়নের কড়াই বরিশাল নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের ৭ম ও ৮ম শ্রেণির প্রায় ২০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এছাড়াও ঝরে পড়া অনেক ছেলেমেয়েরও বিয়ে হয়েছে যে হিসাব কেউ রাখছে না।
চিলমারীর ইউএনও ও উপজেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান গত সেপ্টেম্বরে থানাহাট, রমনা ও রানীগঞ্জ ইউনিয়নকে প্রাথমিকভাবে শতভাগ বাল্যবিমেুক্ত ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারাদেশে করোনার কারণে বিয়ের হার বেড়েছে। তবে তাদের পরিসংখ্যান বলছে, এখানে বাল্যবিয়ের হার কমেছে।
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন