দেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুরে গতকাল রবিবার থেকে শুরু হয়েছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। গতকাল রবিবার দিনাজপুরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি এই মৌসুমে জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এক সপ্তাহে জেলায় তাপমাত্রা কমেছে ৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জেলায় শীতজনিত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। কয়েক দিন ধরে মানুষ সারা দিন শীতের কাপড় পরে চলাচল করছে। বাজারে পুরনো ও গরম কাপড়ের বেচাকেনা বেড়েছে বলে জানান পুরনো কাপড় ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম।
দিনাজপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়া সহকারী আসাদুজ্জামান জানান, জেলায় শীত বাড়ছে।
বৃহস্পতিবার থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার ১৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শুক্রবার ১২.৫, শনিবার ১০.২ ও রবিবার ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। পরিবেশবিদ মোসাদ্দেক হোসেন জানান, বৃষ্টি হলে শীতের তীব্রতা আরো বাড়বে।
নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ
চুয়াডাঙ্গা শহরে সন্ধ্যার পর থেকে তীব্র শীতের কারণে মানুষের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষকে পুরনো কাপড়ের দোকানে শীতবস্ত্র কিনতে দেখা যাচ্ছে। সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের কৃষক হামিদ আলী জানান, তীব্র শীত ও কুয়াশার কারণে বীজতলার ক্ষতির আশঙ্কা আছে। আলু ও ভুট্টা ক্ষেতে রোগবালাই দেখা দিতে পারে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ রকিবুল ইসলাম জানান, চুয়াডাঙ্গায় গতকাল সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে কুয়াশা থাকছে। মাঝেমধ্যে হিমেল বাতাস থাকায় শীত অনুভূত হচ্ছে বেশি।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ফাতেহ আকরাম জানান, শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু ও বয়স্করা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। শিশুরা নিউমোনিয়ায়, বয়স্করা শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিকেল না গড়াতেই ঘন কুয়াশা
গাইবান্ধায় বিকেল না গড়াতেই হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে চারদিক। সারা রাত ঝরছে কুয়াশা। গতকাল দিনভর সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। গ্রামের সড়কগুলোতে সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত হেডলাইট জ্বালিয়ে চলেছে যানবাহন। তীব্র শীতের কারণে সন্ধ্যার পরই জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমে যায়।
বিপাকে আছে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ঘাঘট নদীর বাঁধ, চর ও তীরের মানুষ। অতিদরিদ্র এসব মানুষ অপেক্ষায় আছে সরকারি-বেসরকারি শীতবস্ত্র সাহায্যের জন্য।
গাইবান্ধার বোয়ালী এলাকার কৃষিজীবী ইদ্রিস আলী জানান, প্রতিদিনই শীতের তীব্রতা বাড়ছে। এতে ফসলের মাঠে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। দুপুর ১২টার আগে জমিতে কেউ নামতে চায় না।
ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিত সফুরণ বিবি বলেন, ‘বিকেল থেকে উত্তুরে শীতল হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ঘরের বেড়া সারানো হয়নি। রাতে শীতে জমে যাওয়ার অবস্থা। এখন কম্বল পাওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু কেউই খোঁজ নিচ্ছে না। ’
ভারপ্রাপ্ত জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জুয়েল মিয়া জানান, জেলার জন্য শীতের শুরুতে পাওয়া ৪২ হাজার কম্বল ইউএনওদের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ৪৯০টি কম্বল বিতরণ করা হবে।
গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, শীতজনিত ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত এক সপ্তাহে তিন শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মাটিতেও শয্যা পাততে হচ্ছে।
ব্যাহত স্বাভাবিক জীবনযাত্রা
ঠাকুরগাঁওয়ে এক সপ্তাহ ধরে মধ্যরাত থেকে সকাল ১১টা বা দুপুর ১২টা পর্যন্ত চারদিক কুয়াশায় ঢাকা থাকছে। তার ওপর বইছে হিমেল হাওয়া। শীতের তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। কয়েক দিন ধরে কনকনে ঠাণ্ডায় ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত দিনের বেলাতেও রাস্তায় যানবাহন চালাতে হচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। শীতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে দরিদ্র, শ্রমজীবী ও দিনমজুররা। তাঁদের অনেকে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে খড়কুটা জ্বেলে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে।
হরিনারায়ণপুর মাস্টারপাড়া গ্রামের দিনমজুর রেজাউল ইসলাম জানান, তিনি শীতে শহরে তেমন কাজ পাচ্ছেন না। গ্রামে অন্যের জমিতে দিনচুক্তি কাজ করছেন। ভোরে শুরু করে বিকেল ৫টায় কাজ শেষে ৪০০ টাকা পান। তা দিয়ে সংসারের খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ চালাতে হয়। শীতবস্ত্র কেনার জন্য অতিরিক্ত টাকা থাকে না তাঁদের।
আকচা ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলমগীর জানান, তিনি চার বিঘা জমিতে আলু রোপণ করছেন। ঠাণ্ডায় হাত-পা কাঁপছে। তবু কাজ করতে হচ্ছে ভালো ফলনের জন্য।
শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামের আলী হোসেন জানান, তিনি রিকশাচালক। কয়েক দিন ধরে সকাল ও দুপুর কখন হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। ঘন কুয়াশা ও ঠাণ্ডায় শহরে রিকশার যাত্রী অনেক কমে গেছে। এতে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
নারগুণ ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল জব্বার জানান, তাঁর এলাকায় প্রায় তিন হাজার মানুষের বসবাস, বেশির ভাগই দরিদ্র। চলতি শীতে সরকার থেকে গরিব মানুষদের জন্য তিনি মাত্র আটটি কম্বল পেয়েছেন।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জানান, হতদরিদ্রদের কষ্ট লাঘবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাওয়া ২৮ হাজার কম্বল জেলার পাঁচ উপজেলায় বিতরণ করা হচ্ছে। শীত মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ৫০ হাজার কম্বল ও ২০ লাখ টাকা চাহিদা দেওয়া হয়েছে।