মূল চালক ছাড়াই চলছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ি। সেই গাড়িচাপায় গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হয়েছে।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ওই ‘গাড়ির চালক’ রাসেলকে (২৬) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পল্টন থানার ওসি সালাহ উদ্দিন মিয়া বলেন, ‘গ্রেপ্তার রাসেল গাড়িটির মূল চালক নয়। এ ধরনের ভারী গাড়ি চালানোর তেমন অভিজ্ঞতাও তার নেই।’
নিহত নাঈম নটর ডেম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। গতকাল সকালে সে বাসা থেকে কলেজের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গুলিস্তান হল মার্কেট মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়িটি তাকে চাপা দেয়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক দুপুর সোয়া ১২টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার প্রতিবাদে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা দুপুর ২টার দিকে কলেজের সামনে, মতিঝিল শাপলা চত্বর ও গুলিস্তান এলাকায় অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। তারা নাঈমের মৃত্যুকে হত্যা দাবি করে চালকের ফাঁসি দাবি করে। শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। অনেকের বুকে, পিঠে লেখা ছিল, ‘আমি বাঁচতে চাই’।
নাঈম লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার কাজিরখিল গ্রামের শাহ আলমের ছেলে। মায়ের নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। তার বাবার নীলক্ষেতে বইয়ের ব্যবসা রয়েছে। কামরাঙ্গীর চর ঝাউলাহাটি চৌরাস্তা এলাকায় নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকত সে। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল ছোট।
নাঈমের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন বাবা মো. শাহ আলম। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বারবার বলতে থাকেন, ‘আমি কেন কলেজে যেতে ছেলেকে বিদায় দিলাম, …চিরবিদায় নিয়ে দুনিয়া থেকে চলে গেল সে।’
গতকাল বিকেলে নাঈমের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর তার মরদেহ কামরাঙ্গীর চরের বাসায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে মরদেহ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান নাঈমের বড় ভাই মুনতাছির মামুন।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে নাঈমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা কবি নজরুল কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম ফাহিম বলেন, গুলিস্তান হল মার্কেটের মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় বায়তুল মোকাররমগামী ময়লার গাড়িটি মোড় ঘুরতে গিয়ে নাঈমকে প্রথমে ধাক্কা দেয়, পরে চাপা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার সময় আশপাশে ট্রাফিক পুলিশ ছিল। ব্যস্ত সড়কে ছিল অনেক মানুষ। গাড়িটির গতি বেশি ছিল। অনেক মানুষ রাস্তা পার হচ্ছিল তখন, সেদিকে চালকের নজর ছিল বলে মনে হয়নি পথচারীদের।
প্রত্যক্ষদর্শী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গাড়িটির গতি কম থাকলে দুর্ঘটনাটি হতো না। চলার পথে দেখেছি গাড়িটির গতি বেশি ছিল।’
মূল চালক ছিলেন না
ঘটনার পরপরই গাড়ির চালক রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পল্টন থানা পুলিশ। গাড়িটিও জব্দ করা হয়েছে। ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, রাসেল ডিএসসিসির নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো চালক নন। তিন বছর আগে রাসেল যখন ডিএসসিসিতে ক্লিনার হিসেবে কাজ করতেন, তখনও তিনি সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চালাতেন। এরপর তাঁর চাকরি চলে গেলেও গাড়ি চালানো বন্ধ হয়নি।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় ড্রাইভিংয়ে যিনি ছিলেন তিনি লাইসেন্সকৃত থাকলেও আমাদের নিয়োগ দেওয়া না।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের আয়তন বাড়ায় ময়লার গাড়িচালক সংকট রয়েছে। তাই প্রশিক্ষিত বা লাইসেন্স আছে এমন চালকদের দিয়ে কিছু গাড়ি চালাতে হচ্ছে। সামনে নিজেদের নিয়োগের বাইরে চালক রাখা হবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাসেলের মতো দুই শতাধিক চালক রয়েছেন সিটি করপোরেশনের, যাঁরা ক্লিনার ও পিয়ন হিসেবেই নিয়োগপ্রাপ্ত। মতিঝিল এলাকায় দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সার্জেন্ট কালের কণ্ঠকে বলেন, সিটি করপোরেশনের গাড়ি সব সময়ই বেপরোয়া গতিতে চলে। ময়লার গাড়ির চালকদের কিছু বললেই তাঁরা নানা উল্টাপাল্টা কথা বলেন। বিশেষ করে মেয়রের ভয় দেখান।
প্রতিবাদে সহপাঠীরা
দুপুর থেকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা বিকেল ৫টার দিকে সড়ক ছাড়ার আগে নাঈমের পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব চায় সিটি করপোরেশনের কাছে। এর আগে নটর ডেম কলেজের ফাদার অ্যান্থনি সুশান্ত গোমেজ, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ভিনসেন্ট তিতাস রোজারিও ও শহিদুল হাসান পাঠান ঘটনাস্থলে এসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষার্থীরা সড়ক থেকে সরে যেতে শুরু করলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর আবার যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
এর আগে শিক্ষার্থীরা গুলিস্তানের রাজউক চত্বরে অবরোধ করে। কয়েক শ বিক্ষোভকারী নগর ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করে, কিন্তু প্রধান ফটক বন্ধ থাকায় ভবনের সামনেই স্লোগান দেয় তারা। শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দাবি তুলে ধরে। এগুলো হলো—সবার স্বাভাবিক বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা, ট্রাফিক আইন জোরালো করা, সড়ক আইন বাস্তবায়ন করা, গুলিস্তান মোড়ে ফুট ওভারব্রিজ করা ও ব্যস্ততম মোড়ে ট্রাফিকব্যবস্থা আরো জোরদার করা।
আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী বলে, ‘ডিএসসিসির মেয়র আমাদের ফাদারকে (অধ্যক্ষ) ফোন করেছেন। মেয়র বলেছেন, ওই চালকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উনার আশ্বাসে আমরা আজকের মতো আন্দোলন শেষ করেছি। যদি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় এবং অধ্যক্ষ অনুমতি দেন, তবে আগামীকাল আমরা আবার সড়কে অবস্থান নেব।’
তিন সদস্যের কমিটি : নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সিতওয়াত নাঈমকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএসসিসি। জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু জানান, অন্য দুই সদস্য হলেন মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস (উপসচিব) ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিছুর রহমান। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
অনেক মৃত্যু ঘটেছে ময়লার গাড়িচাপায়
সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িচাপায় গত এক বছরে আরো অনেকের মৃত্যু হয়েছে। গত ৯ আগস্ট রাজধানীর শ্যামপুরে ফারুক হোসেন নামের এক পোশাক শ্রমিক ডিএসসিসির গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান। এর আগে গত ২ মে শাহজাহানপুরে ময়লার ট্রাকের চাপায় স্বপন আহমেদ দিপু (৩৩) নামের এক ব্যাংক কর্মচারী নিহত হন। গত ১৬ এপ্রিল যাত্রাবাড়ীতে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মোস্তাফা (৪০) নামের এক রিকশাচালক নিহত হন। ২০ জানুয়ারি দুপুরে দক্ষিণের একটি বর্জ্যবাহী গাড়ি দয়াগঞ্জে মোটরসাইকেলকে চাপা দেয়। এতে চালক বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন অপারেটর মোহাম্মদ খালিদ প্রাণ হারান।
ডিএসসিসির মোট যানবাহন ৫১৩টি। তবে নিবন্ধিত চালক মাত্র ১৪৭ জন। ২০০টি গাড়ি চলে মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে। তাঁদের বেশির ভাগই ক্লিনার। যাঁদের বেশির ভাগের নেই তেমন প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স। বাকি ১৬৬টি গাড়ি কিভাবে চলে সেটার সঠিক তথ্য নেই জানিয়ে ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, নিবন্ধিত চালক ছাড়া ডিএসসিসির বাকি গাড়িগুলো চলে অদক্ষ ও অনিবন্ধিত চালক দিয়ে। ফলে সংস্থার গাড়িগুলো মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।