English

33 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৫
- Advertisement -

শোকের প্রতিধ্বনি: পোপ ফ্রান্সিসের প্রস্থান ও এক বৈশ্বিক মানবতাবোধের মূল্যায়ন

- Advertisements -

এস এম আজাদ হোসেন: বিশ্বব্যাপী ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও মানবিক পরিমণ্ডলে যিনি হয়ে উঠেছিলেন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, সেই পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যু শুধু ক্যাথলিক বিশ্ব নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এবং ভ্যাটিকান সিটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর জীবন ও কর্ম ছিল শান্তির বার্তাবাহক, সেবার প্রতীক এবং সংলাপের এক মহামঞ্চ। বাংলাদেশ সরকার যখন তাঁর প্রয়াণে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে, তখন আমরা কেবল এক ধর্মীয় নেতাকে নয়, বরং একজন মানবিক বিবেককে সম্মান জানাচ্ছি।

এক মহামানবের প্রস্থান
পোপ ফ্রান্সিসের জীবন ছিল সততা, সরলতা ও সেবামূলক মনোভাবের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ২০১৩ সালে পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি শুধুমাত্র ক্যাথলিক চার্চের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি, বরং বিশ্ব মানবতার বৃহত্তর পরিসরে নিজের অবস্থানকে স্থাপন করেছেন। সাম্য, দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ রক্ষা, উদ্বাস্তুদের অধিকার এবং আন্তধর্মীয় সংলাপে তাঁর ভূমিকা আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন সেই কণ্ঠস্বর, যিনি বলেছিলেন-“মসজিদে বিস্ফোরণে যেভাবে আমি কষ্ট পাই, ঠিক তেমনভাবেই গির্জায় বিস্ফোরণে কষ্ট পাই। কেননা, মানুষের রক্তের কোনো ধর্ম নেই।” এই একটি বাক্যেই তিনি মানবতাবোধের সারকথা ব্যক্ত করেছিলেন।

বাংলাদেশে শোক পালনের তাৎপর্য
বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী এবং গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত সিদ্ধান্ত। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যে বার্তাটি দিল, তা হলো-মানবতা, সংবেদনশীলতা এবং আন্তধর্মীয় সহাবস্থানের চর্চা কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতায় নয়, কার্যতও প্রমাণিত হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় শোক পালনের এই উদ্যোগ কেবল ভ্যাটিকান বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়; এটি বিশ্বশান্তি, সহনশীলতা এবং বৈচিত্র্যকে সম্মান জানাবার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই উদ্যোগ আমাদের বহুত্ববাদী সমাজের সৌন্দর্য এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির শিকড়কে আরও দৃঢ় করে তোলে।

পোপ ফ্রান্সিস: চিন্তার মুক্তি ও চেতনার নবজাগরণ
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন অন্যরকম এক ধর্মগুরু, যিনি ধর্মীয় কর্তৃত্বের জাঁকজমক ও অভিজাততার আবরণ সরিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। তিনি ছিলেন প্রথম ‘জেসুইট’ পোপ, প্রথম ‘আমেরিকান’ পোপ এবং প্রথম ‘ফ্রান্সিস’ নামধারী পোপ, যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল নবচিন্তার ছোঁয়া।
তিনি গোঁড়ামির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাস্তবধর্মী এক তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন-যেখানে ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায় দরিদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে, পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে। অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দারিদ্র্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তিনি ধর্মের আলোচনায় টেনে এনেছেন।

ধর্মীয় সহাবস্থানে তাঁর ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, বিভাজন এবং সহিংসতার বিপরীতে পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন এক নির্ভীক দূত। মুসলিম, ইহুদি, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন ও আন্তধর্মীয় সংলাপের প্রচেষ্টা মানবজাতিকে আরও একত্রিত করতে চেষ্টা করেছে।

বাংলাদেশ সফরকালে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মুখে যখন “রোহিঙ্গা” শব্দটি উচ্চারিত হয়, তখন সারা বিশ্ব বুঝতে পারে, এই ধর্মীয় নেতা কেবল প্রার্থনার মানুষ নন, তিনি প্রতিবাদেরও প্রতীক।

আমাদের জন্য শিক্ষা
পোপ ফ্রান্সিসের জীবন আমাদের একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে শিখিয়েছে- নৈতিকতা এবং মানবতা কোনো ধর্ম, জাতি বা ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বিশ্বাসের দৃঢ়তায় নয়, সহানুভূতির বিস্তারে ধর্ম তার প্রকৃত মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে যেখানে ধর্মের অপব্যবহার প্রায়শই সহিংসতা ও বিভাজনের হাতিয়ার হয়, সেখানে তাঁর মত একজন ধর্মীয় নেতার জীবনদর্শন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-সকল জায়গায় পোপ ফ্রান্সিসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনদর্শনকে আলোচনার বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও নাগরিক সমাজের করণীয়
পোপের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শোক পালন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি নৈতিক অবস্থান গ্রহণের বিষয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা যে বার্তাটি বিশ্বের কাছে দিতে পেরেছি, তা হলো- ‘আমরা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
এই প্রতিশ্রুতি কেবল সরকারের নয়, নাগরিক সমাজেরও। আন্তধর্মীয় বোঝাপড়া, সংলাপ ও সহমর্মিতাকে বাস্তব জীবনে চর্চা করা উচিত আমাদের সকলের। ধর্মের নামে বিদ্বেষের বদলে ভালোবাসা ও সহযোগিতার বার্তা ছড়াতে হবে ঘরে ঘরে, সমাজে সমাজে।

শেষ কথা
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে বিশ্ব হারিয়েছে এক নীতিবান, মানবিক এবং দূরদর্শী নেতাকে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের শিখিয়ে গেছে, সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং সংলাপ-এ তিনটি শক্তিই পারে একটি বিভক্ত বিশ্বকে একত্র করতে।
বাংলাদেশ যখন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখে, তখন এটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি মানবতার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। এই শোক যেন আমাদের সহনশীলতার চর্চা এবং শান্তির পথে আরো দৃঢ় করে। পোপ ফ্রান্সিস হয়তো আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর কণ্ঠস্বর, তাঁর প্রজ্ঞা-এ সবই থাকবে অনুপ্রেরণা হয়ে।

লেখক: কলাম লেখক, সমাজকর্মী।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন