একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, আগুন নেভানোর জন্য সরঞ্জাম ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব, নদী থেকে পাইপ দিয়ে পানি তোলার মতো ন্যূনতম ব্যবস্থা না থাকা এবং শুরুতে আগুন নেভানোর কোনো চেষ্টা না করার কারণেই অভিযান-১০ নামের লঞ্চটিতে আগুন এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। দুর্ঘটনাটির পর বিআইডাব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা বিভাগের পরিচালক রফিকুল ইসলাম নিজের মুখে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘নৌযানগুলোতে দুর্ঘটনার অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করা হলেও অগ্নিকাণ্ডের মহড়া আসলে এত দিন হয়নি। এবার আমরা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেব।’ সুতরাং তাঁর কথাতেই এই দুর্ঘটনার পেছনে অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের নৌ, সড়ক ও রেলপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে, সবই অবহেলার জন্য ঘটে। আর এই অবহেলা হচ্ছে মূলত পরিচালনা বা প্রায়োগিক স্তরে। একটা কিছু উন্নয়নের পর এর পরিচালনার দিকে নিবিড় নজর দিতে হয়। পরিবহনের ক্ষেত্রে কারা যানবাহন চালাবে, মাঠ পর্যায়ে যানবাহন ও রুট নজরদারি কারা করবে, তাদের কে নিয়ন্ত্রণ করবে, ওপরের দিকে কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব কতটুকু থাকবে—সেটা সুস্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক করতে হয়। আমাদের সড়কে যেমন নসিমন-করিমন বা ভটভটি আছে, নৌপথেও এ রকম অনেক রেজিস্ট্রিবিহীন যান আছে। এগুলো আছে মানে আমাদের অবহেলাও আছে। এর বিপরীতে আমাদের কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নেই। রেলওয়ের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি ইঞ্জিন কেনার পর ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না।
মূল সমস্যাই হচ্ছে এই দেখার কাজটিতে অনীহা। আমাদের একেকটা সংস্থায় একদম ওপর থেকে মাঝারি স্তর পর্যন্ত, বিশেষ করে সুপারভাইজার পর্যন্ত সবার চোখই ওপরের দিকে নিবদ্ধ থাকে। নিচের দিকে যে লোকবল দেওয়া হয়েছে তাদের কাজটা কেউ দেখে না। আবার কোথাও কোথাও লোকের ঘাটতি আছে, তা পূরণ করা হয় না। সরকারি সংস্থাগুলোতে এই ঘাটতিগুলো জিইয়ে রেখে ওপর মহলের অবহেলাকে সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে আমরা বারবার হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো দেখি।
সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তদন্তের ক্ষেত্রে। যাঁরা এই তদন্তটা করেন তাঁরা অভিজাত শ্রেণির। যাঁদের অবহেলার জন্য দুর্ঘটনাগুলো ঘটে, তাঁরাই এর তদন্তের দায়িত্বে থাকেন। ফলে তাঁদের চোখ আর জনগণের চোখ এক হয় না। প্রতিটি ঘটনার পর আমরা সহজ-সরলভাবে বলে থাকি, এটির ফিটনেস ছিল না, চালকের লাইসেন্স ছিল না, অনুমোদনহীনভাবে ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হয়েছে, নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব সত্য, কিন্তু এসব অনিয়ম দেখার দায়িত্বে কে ছিলেন এবং ঘটনার পর এর দায়িত্বটা কে নেবেন? এ ক্ষেত্রে কোনো জবাব পাওয়া যায় না।
দুর্ঘটনা উন্নত দেশগুলোতেও ঘটে। তারা এটাকে বলে দৈব ঘটনা। সব কিছু ঠিক থাকার পরও যেটা ঘটে যেতে পারে, সেটাই দুর্ঘটনা। কিন্তু আমাদের দুর্ঘটনাগুলো ম্যান-মেইড বা মানুষের হাতে তৈরি। আবার ম্যান-মেইড হলে শোধরানো যায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়ী করা যায়, কিন্তু এখানে এটি হয় না। তাই আমি মনে করি, এই সংস্কৃতিটা এমন এক অশনিসংকেত, যা আরো বেশি, আরো বড় দুর্ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকার কথা বলে। কারণ দিন দিন আমাদের ব্যবহারকারী বাড়ছে, চলাচলের সব মাধ্যমেই পরিচালনার বিষয়ে জটিলতা বাড়ছে, কিন্তু সমাধানের দিকে নজর পড়ছে না।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলা দরকার। আমাদের শুধু উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের বাইরেও কিছু ভাবতে হবে। উন্নয়ন মানে কিছু অর্জন। এটি থেকে সুফল পেতে হলে একটিকে টেকসই করতে হয়, নিরাপদ রাখতে হয়। আমি বলব, ওই জায়গায় যথেষ্ট পরিমাণে ঘাটতি আছে। আমাদের পরিকল্পনায়ও মারাত্মক ঘাটতি আছে। সরকার থেকে আরম্ভ করে সবাই শুধু উন্নয়নের দিকেই নজর দিয়ে রেখেছে। কিন্তু উন্নয়নটা হয়ে যাওয়ার পর পরিচালনা স্তরে যে দায়বদ্ধতা আছে, সেটা ভুলে যাচ্ছি আমরা। অথচ এই জায়গাটায় নজর দেওয়াই বিজ্ঞানের কথা। সুতরাং আমার বক্তব্যটি হলো, আমরা উন্নয়নে যেভাবে আনন্দিত হই, সেভাবে যদি ব্যবহাকারীকে নিরাপত্তাটা দিতে না পারি, তাহলে উন্নয়ন টেকসই হয় না। তাই টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের গলদ গোড়ায়।
নৌযানের নকশা পরিবর্তন, ডেক বড় করা, অনুমোদন ছাড়া ইঞ্জিন পরিবর্তন করা, মেয়াদোত্তীর্ণ নৌযান চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী বহন—নৌপথে নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আমরা একটি কথা বলে থাকি, যানবাহনের মালিক বা ব্যবসায়ীরা অসৎ। কিন্তু আমরা একটি কথা ভুলে যাই কিংবা জানতে চাই না—কমার্শিয়াল এনটিটি বা বাণিজ্যিক সত্তা বলতে একটি কথা আছে। কমার্শিয়াল এনটিটির কাজ হলো জনস্বার্থে যা করার কথা নয়, সে সেটাই করবে তার মুনাফার স্বার্থে। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, সব জায়গায়ই ঘটে। কমার্শিয়াল এনটিটির সবচেয়ে বড় জিনিসটিই হলো তার মুনাফা ম্যাক্সিমাইজ করা। বিপরীতে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ হলো, তার লাগাম টেনে ধরা। সুতরাং সরকার যখন কোনো নিয়ম-নীতির কথা বলে, তখন বললেই বা জারি করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এটিকে বলবৎ করতে হয়। পুরো পৃথিবীতেই বলা হয় উন্নয়নটি সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু এখানে রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা, নিরাপত্তাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।
সুতরাং আমাদের রোগের উপসর্গের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, মূল কারণের দিকে নজর দিতে হবে। ভবিষ্যতে সমস্যাগুলো জটিল থেকে জটিলতর হবে। আমাদের লোক বাড়ছে, ব্যবসায়ী বাড়ছে, বিনিয়োগকারী বাড়ছে, নদীপথে প্রতিদিনই নতুন নতুন নৌযান নামছে, নৌযানের গতি বাড়ছে; কিন্তু সে অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা বাড়ছে না। এই নৌ দুর্ঘটনা উপসর্গটির মূল রোগ হলো অবহেলা। এটি সারাতে না পারলে আমাদের কোনো পথই নিরাপদ হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ ও সাবেক পরিচালক, দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউ, বুয়েট