English

16 C
Dhaka
সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
- Advertisement -

‘বঙ্গবন্ধু ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশা’

- Advertisements -

এস এম আজাদ হোসেন: শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, এ জগতে কেউ কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন৷ আমার মতে, এই ৩টি বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷

কিউবার প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর কথাই ধরুন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি৷”

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট (১৯৭২ সালের এক সাক্ষাৎকারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনার শক্তি কোথায়?” বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি৷” ‘‘আর আপনার দুর্বল দিকটা কী?” বঙ্গবন্ধুর উত্তর, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি৷”

এই হলেন বঙ্গবন্ধু৷ জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর অপার আস্থা-বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা, মমত্ববোধ, সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্ত সমৃদ্ধ মানুষ – বঙ্গবন্ধু৷

স্বাধীনতা তো দিলেন, কিন্তু আসলে কী চেয়েছিলেন বাংলাদেশের এই বন্ধু? কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি? গড়তে চেয়েছিলেন কোন বাংলাদেশ? আমার মতে, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তাঁরই উদ্ভাবিত দেশের মাটি থেকে উত্থিত অথবা স্বদেশজাত উন্নয়নের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে এমন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে, যে বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা; যে বাংলাদেশে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি হবে চিরস্থায়ী; যে বাংলাদেশ হবে চিরতরে ক্ষুধামুক্ত-শোষণমুক্ত, যে বাংলাদেশে মানব-মুক্তি নিশ্চিত হবে; যে বাংলাদেশে নিশ্চিত হবে মানুষের সুযোগের সমতা; যে বাংলাদেশ হবে বঞ্চনামুক্ত-শোষণমুক্ত-বৈষম্যমুক্ত-সমতাভিত্তিক-অসাম্প্রদায়িক দেশ; যে বাংলাদেশ হবে সুস্থ-সবল-জ্ঞান-চেতনাসমৃদ্ধ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষের দেশ-এককথায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ৷

‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে৷ এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয়৷ আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে৷ আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়বো৷”

বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন৷ এ দর্শনের ভিত্তিমূলে ছিল এক ঐতিহাসিক বিশ্বাস যে, কেবল জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে৷ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী, গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশ, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ (সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৭)৷ এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন হলো তাঁর স্বপ্ন – সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন৷

বঙ্গবন্ধু গড়তে চেয়েছিলেন ‘সুস্থ-সবল-জ্ঞানসমৃদ্ধ-ভেদবৈষম্যহীন মানুষের উন্নত বাংলাদেশ’৷ বঙ্গবন্ধু তাঁরই উদ্ভাবিত ঐ উন্নয়ন দর্শন বাস্তবে রূপ দিতে অন্যতম মৌল-উপাদান হিসেবে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন৷ আর সে কারণেই মালিকানার নীতি বিষয়ে সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হলো গুরুত্বক্রম অনুসারে রাষ্ট্রে মালিকানা ব্যবস্থা হবে: প্রথমত, রাষ্ট্রীয় মালিকানা; দ্বিতীয়ত, সমবায়ী মালিকানা, এবং তৃতীয়ত, (নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে) ব্যক্তিগত মালিকানা৷ বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন গ্রামীণ সমাজে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রতিটি গ্রামে গণমুখী সমবায় সমিতি গঠন করা হবে, যেখানে গরিব মানুষ যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিক হবেন; যেখানে সমবায়ের সংহত শক্তি গরিব মানুষকে জোতদার-ধনী কৃষকের শোষণ থেকে মুক্তি দেবে; যেখানে মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা গরিবের শ্রমের ফসল আর লুট করতে পারবে না; যেখানে শোষণ ও কোটারি স্বার্থ চিরতরে উচ্ছেদ হয়ে যাবে৷

গণমানুষের শেখ মুজিব, ইতিহাসের মহানায়ক, তবুও…
৭ই মার্চ ১৯৭১৷ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর অবিনাশী মহাকাব্য শেষ করলেন৷ ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷” এই মহাকাব্যের পর তিনি আর শুধুমাত্র তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা রইলেন না৷ তিনি হয়ে গেলেন গণমানুষের শেখ মুজিব, ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক মহানায়ক৷ ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়েই বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের জাতির পিতা৷

কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর শুরু হলো নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পালা৷ বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশাতেই এ সব ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন, তার প্রমাণও আছে৷ ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়৷ যার ফলশ্রুতিতে কিছু পথভ্রষ্ট সেনা কর্মকর্তা কিংবা দেশি-বিদেশি স্বাধীনতাবিরোধী চক্রই শুধু নয়, ১৫ই আগস্টের পট বিশ্লেষণে মোস্তাকগং এবং দলের ভেতর ঘাপ্টি মেরে থাকা তৎকালীন বেশ কিছু নেতার নামও সামনে চলে আসে৷ ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক দিন৷ এই দিনটি পুরো জাতির কপালে কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছে জাতির জনকের খুনি হিসেবে৷এরপর থেকে দিনটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূর শোকের দিন এবং আগস্ট শোকের মাস হিসাবে পরিচিত। যিনি আজীবন সংগ্রাম আর ত্যাগে আমাদের মহান স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় তারই প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল হায়েনার দল।

১৫ই আগস্টের পর একটা দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধু শব্দটি বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত ছিল৷ ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে রঞ্জিত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল মৌলবাদী আর সাম্প্রদায়িক হায়েনাদের উচ্ছিষ্ট ভাগাড়ে৷

বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ – এই শব্দ তিনটি মূলত সমার্থক৷ এই তিনটির যে কোনো একটিকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করার কোনো সুযোগ নেই৷ এই তিনটি শব্দের যে কোনো একটি যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখনই বাঙালির জীবনে জাতীয় দুর্যোগ নেমে এসেছে৷ বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুটি হতে পারে নিজ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাতেই৷ আজ যখন পাড়ার মোড়ে কোনো চিহ্নিত খুনি বা ধর্ষকের ছবির সাথে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখি, তখন জাতির জনকের ঐ ভবিষ্যদ্বাণীই বারংবার মনে পড়ে৷
আওয়ামী লীগকেই দায়িত্ব নিতে হবে তারা গণমানুষের শেখ মুজিবকে ১৬ কোটি মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের ঐতিহাসিক ঋণ শোধ করবে৷ এই দায় তাদের মেটাতেই হবে, কেন না একমাত্র বঙ্গবন্ধু বাঁচলেই বাঁচবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ৷

আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। বাঙালি জাতিকে দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে। আর এসব করতে গিয়ে তিনি যা যা করেছেন, সেটাই তার আদর্শ। এ আদর্শের মূল কথা ত্যাগ আর সংগ্রাম। যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ, লোভ, মোহ, পদ-পদবির ঊর্ধ্বে উঠে নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তার লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে আমরা দেখতে পাই, তিনি কখনও ক্ষমতার পেছনে দৌড়াননি। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত-উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। আর তাতে অবিচল থেকে তিনি সমসাময়িক আরও অনেক বড় রাজনীতিবিদকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা যায় এভাবে- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়া, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-প্রগতিশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলা আর মানুষের জন্য ভালোবাসা। আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনা, সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের জনগণের সেবকে পরিণত করা, স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করা, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা, দেশ কী দিল, সেটা না ভেবে দেশকে কী দিলাম নিশ্চিত করা, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, যা অন্যের স্বাধীনতা বিনষ্ট না করে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। নিচের দিকে তাকিয়ে চলা যাতে হোঁচট না খেতে হয়। বঙ্গবন্ধু তার আদর্শকে সারা জীবন কাজের মাধ্যমে, আচরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের পদ নিয়ে ত্যাগের রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। যেটা শুধু তার নির্লোভ মানসিকতাই নয়, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ এবং রাজনীতি ও মানুষের প্রতি কাজ করার দৃঢ়প্রত্যয় তুলে ধরে।

বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ত্যাগের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হল- ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ডাকা ধর্মঘটে নেতৃত্বদানের অভিযোগে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফেরত পাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। এদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পারা সবসময়ই সম্মান ও গর্বের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রায় সব ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন। কিন্তু নিজের বিশ্বাস ও কাজে আস্থাশীল ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু মুচলেকা দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব ফেরত নেননি।

জাতিরজনক গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপস করেননি বলেই তার জীবদ্দশায় তাকে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। অথচ পাকিস্তানি শাসকদের লোভনীয় প্রস্তাব মেনে নিয়ে তিনি অনায়াসেই বড় পদ নিয়ে আরাম-আয়েশে বিলাসী জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু আজ এই ত্যাগ, মানুষের জন্য ভালোবাসা, বৈষম্যহীন সমাজের চিন্তা যেন অনেকটা সুদূরপরাহত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিসংবাদিত নেতা৷ যাঁর সাথে বাঙালির রয়েছে আত্মার সংযোগ, যাঁর কাছে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে আত্মপরিচয়ের ঠিকানা৷  ইতিহাস বলে, হাজার বছর ধরে এই জাতি ও জনপদের অস্তিত্ব টিকে থাকলেও তা কখনোই স্বাধীন সার্বভৌম একক রাষ্ট্র ছিল না৷ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখার সূচনা৷  ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই জনগণের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন৷ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পেছনে স্থপতির ভূমিকায় যিনি ছিলেন এবং আপামর জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যিনি শোষক ও স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷

সত্য হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই এক উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি নেতা তো ছিলেনই তার চাইতেও বেশি ছিলেন কোটি মানুষের মনের কাছাকাছি এক প্রাণের মানুষ, আপন মানুষ৷

আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধু কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর নেতা নন, তিনি এদেশের সকল মানুষের হৃদয়ের নেতা, জনতার নেতা৷ শত বিপদ, নির্যাতন, নিপীড়ন, জেল-জুলুম, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে তিনি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন৷ একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন৷ তাঁর কাছে এই দেশের সবাই কৃতজ্ঞ৷ আমাদের এখানে অনেকেই ঢালাও ভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণের কথা বলেন, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও মূল্যবোধ বুঝতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান রচিত তিনটি বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘কারাগারের রোজনামতা’ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীন’ পড়তে হবে৷ এই গ্রন্থগুলির ছত্রে ছত্রে তার জীবন দর্শন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ তিনি জনগণের জন্য রাজনীতি করেছেন, সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বলেছেন৷ অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষেই লড়াই করেছেন৷ এই অনন্য মানুষটি চেয়েছেন, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, সুখী হোক, প্রাণ ভরে হাসুক, হেসে খেলে বেড়াক৷ আপাতদৃষ্টিতে এই চাওয়াগুলো হয়তো সামান্যই, কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে এই চাওয়াগুলির তাৎপর্য অসামান্য৷ দেশের সাধারণ মানুষদের কথা ভেবেছেন তিনি, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন৷ কিন্তু এই হাসি তখনই ফুটবে যখন সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে, দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, সর্বস্তরে সবধরনের দুর্নীতি দূর হবে৷

শোকের মাস আগস্টের ১৫তম দিন আজ। জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে শোকের কর্মসূচির মাধ্যমে পুরো মাস তাকে স্মরণ করছে। পথে-ঘাটে, পাড়া-মহল্লায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান, মিছিল-স্লোগান ও তার ভাষণ শোনা যাচ্ছে। জাতীয় জীবনে তার আদর্শের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সত্যিকার সম্মান জানানো সম্ভব।দেশের জ্ঞানী-গুণিদের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার,শাস্তি প্রদান ও তাঁর আজীবনের চাওয়া পূরণ করতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন, আন্তরিকতার সাথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা৷ কেননা তার স্বপ্নের বাংলা গড়াই চূড়ান্ত অর্থে তাঁকে সম্মান জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়৷

লেখক– সাংবাদিক, কলাম লেখক। smazadh@yahoo.com

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন