রাসেল মাহমুদ জিমি। দেশের হকিতে এক নম্বর তারকা। ২১ বছরের ক্যারিয়ার। বয়স ৩৭ পেরিয়ে। এখনো তরতাজা পারফরম্যান্স। মাঠে খেলতে নামলে নতুনদের সামনে জিমি যেন উড়ন্ত খেলোয়াড়। শুধু দেশি খেলোয়াড় নয়, বিদেশি খেলোয়াড় যারাই বাংলাদেশে খেলতে এসেছেন তাদের চোখেও জিমি অসাধারণ একজন পারফরম্যান্স। ইউরোপ-আমেরিকার হকি দেশ থেকে যারা ঢাকায় খেলতে এসেছিলেন তাদের সামনেও জিমিকে আলাদা করে চেনা গেছে।
গত প্রিমিয়ার লিগে যেসব বিদেশি খেলোয়াড় এসেছিলেন তাদের চেয়েও ঢের বেশি ভালো পারফরম্যান্স ছিলেন রাসেল মাহমুদ জিমি। সাত মাস পর বিজয় দিবস হকি শুরু হয়েছে। জাতীয় দলের প্রায় সবাই খেলছেন, ওমানে এশিয়া কাপ অনূর্ধ্ব-২১ হকিতে খেলে বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তাদের সামনেও জিমি যেন মাঠের লড়াইয়ে আলাদা একজন খেলোয়াড়। লড়াকু পারফরম্যান্স। জিমির সঙ্গের অনেক খেলোয়াড় মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। জিমি আছেন এখনো, স্টিক হাতে। দেখে বোঝার ক্ষমতা নেই হাজারো প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জিমি সব সময় নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। মামুনুর রহমান চয়ন, পিন্টু, শহিদুল্লাহ টিটুরা জিমির ফিটনেস দেখে মুগ্ধ।
গতকাল হকি স্টেডিয়ামে বিজয় দিবস হকির প্রথম সেমিফাইনালে নৌবাহিনী ৪-১ গোলে হকি খেলোয়াড় কল্যাণ ঐক্য পরিষদকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পর মাঠেই রিকভারি করছিলেন জিমি। ওখানেই কথা হয় জিমির সঙ্গে। এখনো ফিটনেস ধরে রাখার রহস্য কী। জিমির জবাব, ‘আমি আমার ২১-২২ বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় ১৬ বছর ধরে দুপুরে ভাত খাই না। এই যে এখন ম্যাচ খেললাম। আজকে নাশতাও খাইনি। নৌবাহিনী থেকে খিচুড়ি দেওয়া হয়েছে এটাই খাচ্ছি।’
এটা কী করে সম্ভব? না খেয়ে জিমি খেলেন কীভাবে। ‘আমি নিজেকে সেভাবেই তৈরি করেছি। সকালে ভালোভাবে খেয়ে নিলে দুপুরে লাগে না। যত বেশি খাবেন, মোটা হবেন। দুপুরে বাসায় থাকলেও আমি ভাত খাই না।’ ভারতীয় হকির তারকা ধনরাজ পিল্লাই হচ্ছেন জিমির আদর্শের খেলোয়াড়। তাকে দেখে অনেক কিছু শিখেছেন। ‘আমি ধনরাজের কাছ থেকে রিসিভিং, পাসিংও শিখেছি। উনি আমার আইডল। আমি পিল্লাইকে খেয়াল করতাম-বললেন জিমি।
ক্লাবের খেলা হোক কিংবা জাতীয় দলের খেলা, সবসময় একই রকম থাকেন জিমি। একবার লম্বা সময়ের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল জিমিকে। মাঠে ফিরেই আবার জিমি নিজেকে দেখিয়েছেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি। জিমি একই লাইফস্টাইল ফলো করে নিজেকে তুলে ধরেছেন ঈর্ষণীয়ভাবে। দেশের হকিতে এত খেলোয়াড়দের মধ্যেও জিমিকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। জিমির দোষ মাঠে আম্পায়ারের ভুল ধরিয়ে দেন। হকির আইনকানুন শেখার চেষ্টা করেন তিনি। যারা নিয়মিত খেলা দেখেন তাদের কথা হচ্ছে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে আম্পায়ার সেটি খতিয়ে দেখেন, ১০টা আপত্তির মধ্যে ৯টাই জিমির পক্ষে যায়।
এসব দেখে প্রতিপক্ষ ক্লাব জিমিকে অপবাদ দেন ‘জিমি ভালো না’। যারা বলছেন জিমি ভালো না। তারাও জানেন জিমির কথা ঠিক। কিন্তু সেটি নিজ নিজ দলের স্বার্থে সত্য প্রকাশ করতে চান না। এসব কারণে জিমিকে বারবার শাস্তির কবলে পড়তে হয়েছে। জিমি মাঠের বাইরেও ঠোঁঠকাটা জিমি। মাঠের বাইরের কথার জের টেনে ফেডারেশনের কিছু কর্তা এবং ক্লাবের অসাধু কিছু কর্তা মিলে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে অমান্য করার অপরাধ বানিয়ে জিমিকে শাস্তি দেওয়ার ইতিহাসও রয়েছে। খেলা শেষে সবাই চলে গেছেন। পরদিন শোনা গেল আম্পায়ার জিমির বিপক্ষে রিপোর্ট দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এর পেছনে প্রভাব খাটিয়েছেন কয়েক জন।
জিমির ক্যারিয়ার শেষ করার জন্য বহু চেষ্টা করা হয়েছে। এত কিছু মোকাবিলা করে খেলার মাঠে টিকে থাকা কঠিন। ধৈর্য নিয়ে জিমি টিকে আছেন তার খেলা, একাগ্রতা, পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে। জিমির বাবা আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়া ছিলেন দেশের হকির কিংবদন্তি। প্রথমবার যখন জিমি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, তখন সমালোচনা করে বলা হয়েছিল বাবা কোচ বলেই ছেলেকে নিয়েছে। সোনা মিয়া বারবার বলেছিলেন, জিমি অনেক ভালো খেলোয়াড়। জিমিকে আমি কোচের চোখে দেখেছি, বাবার চোখে নয়।’ তখন কেউ না শুনলেও সোনা মিয়ার কথাই ঠিক ছিল, তিনি রত্ন চিনতে ভুল করেননি। জিমির এই লম্বা ক্যারিয়ারে দেশি- বিদেশি খেলোয়াড়দের মান বিচারে বারবার প্রমাণ হয়েছে জিমি দেশের হকি মাঠের সেরা খেলোয়াড়। এক নম্বর তারকা।