পরমাণু বোমা কেন এত ধ্বংসাত্মক? তা নিয়ে অনেকের কৌতুহল আছে। এই বোমা এতটাই ধ্বংসাত্মক তা হারে হারে টের পেয়েছে জাপান।
তিন দিনের ব্যবধানে দেশটির হিরোশিমা ও নাগাসাকি দুটি পরমাণু বোমা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা আজও ভুলতে পারেনি জাপান।
৬ আগস্ট ১৯৪৫। সকালে হঠাৎ এক ভয়ানক শব্দে দিশাহারা হিরোশিমার মানুষ। আকাশ থেকে নেমে আসা বিভীষিকা মুহূর্তের মধ্যেই নরককুণ্ড বানিয়ে ফেলল শহরটাকে। কয়েক হাজার মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ হারায়। যারা বেঁচে যায়, না বাঁচলেই বোধ হয় ভালো হতো তাঁদের জন্য।
নরকের আগুনে দগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার কতটা ভয়াবহ, তা ভুক্তভোগীই জানে।
এক মাসের মধ্যে শুধু হিরোশিমায়ই মারা যায় দেড় লাখ মানুষ, তিন দিন পর (৯ আগস্ট) নাগাসাকিতে একই রকমের বিস্ফোরণে মারা যায় প্রায় আশি হাজার। হিরোশিমা নাগাসাকি সেই ক্ষত ৭৮ বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
হিরোশিমাতে ও নাগাসাকিতে আকাশ থেকে যে বোমা ফেলেছিল মার্কিন সৈনিকরা, তা সাধারণ কোনো বোমা ছিল না। সেটি ছিল নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার সবচেয়ে নেতিবাচক উদাহরণ।
বিক্রিয়া বলতে একসময় শুধুই রাসায়নিক বিক্রিয়াকেই বোঝানো হতো। রাসায়নিক বিক্রিয়া একাধিক মৌলের মধ্যে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান হয়, এর ফলে একাধিক মৌল মিলে তৈরি হয় নতুন এক যৌগিক পদার্থ। এসব বিক্রিয়া মৌলগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন বৈশিষ্ট্যের যৌগিক পদার্থ তৈরি করে ঠিকই, কিন্তু এতে মৌলগুলোর নিজস্ব ধর্মে কোনো পরিবর্তন আসে না। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ কথা বলা যায় না।
এই বিক্রিয়ায় এক ধরনের মৌলিক পদার্থ পরিবর্তীত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের মৌলে রূপ নেয়। তাই বদলে যায় ধর্ম, বৈশিষ্ট্য, এমনকি আকার-আকৃতি, রং ও গন্ধেরও পরিবর্তন ঘটে। তাপমাত্রা চাপ ঘনমাত্রা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে রাসায়নিক বিক্রিয়া। কিন্তু রাসায়নিক বিক্রিয়া ছাড়াও যে আরো এক ধরনের বিক্রিয়া থাকতে পারে, সে ব্যাপারটা জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের। সেটা নিউক্লিয়ার (পরমাণু) বিক্রিয়া।
রাসায়নিক বিক্রিয়া পর্যবেক্ষক বা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কিন্তু ইচ্ছামতো ঘটানো যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থকে আবার বিপরীত বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক উপাদানগুলো ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া গবেষকের কেরামতি অনেক কম। এই বিক্রিয়া একবার সংঘটিত হলে চাইলেই আবার সেটাকে পেছন থেকে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রাকৃতিকভাবে ঘটে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে প্রাকৃতিক ঘটনা বলতে যা বোঝায় এটা তেমন নয়। প্রাকৃতিকভাবে যেসব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, চাইলে আপনি সেগুলোকে নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া— যেটা প্রাকৃতিকভাবে ঘটে—আপনি চাইলেই সেটাকে থামাতে পারেন না। যেমন তেজস্ক্রিয় ভাঙন। তেজস্ক্রিয় পদার্থের নিউক্লিয়াসে ভাঙন ধরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অনেক চেষ্টা করে দেখেছেন একে থামানো যায় কি না। মাত্রা পরিবর্তন করে দেখেছেন, চাপের পার্থক্য তৈরি করে দেখেছেন, পুরু দেয়ালের ধাতব বাক্সের ভেতর তেজস্ক্রিয় পদার্থ রেখে দেখেছেন—কোনোভাবেই এ বিক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, কৃত্রিমভাবে ও রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত করা যায়। কিন্তু কাজটা অত সহজ নয়। তাই বাংলাদেশের আগে মাত্র ত্রিশটি দেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের মালিক হয়েছে।
আমরা আগেই দেখেছি, কোনো পরমাণুর বাইরে থেকে একটা ইলেকট্রন সরিয়ে নিলে সেই পরামাণু আয়নে পরিণত হয়, কিন্তু পরমাণুর মূল ধর্মের কোনো পার্থক্য তৈরি হয় না এতে। কিন্তু যদি এর নিউক্লিয়াস থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় একটা বা দুইটা প্রোটন, তাহলে পুরো পরমাণুর ধর্মটাই বদলে যায় আমূলে।
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর বাইরে কক্ষপথ থেকে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটে। তাই পরামাণুগুলো নিজস্ব ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। অন্যদিকে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া নিউক্লিয়াসে ভাঙন ধরলে কমে যায় পারমাণবিক ভর সংখ্যা। দুটি ছোট নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে যেমন ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি করতে পারে, তেমনি ভারী নিউক্লিয়াস ভেঙে ছোট ছোট একাধিক নিউক্লিয়াসে পরিণত করা সম্ভব। এই যে নিউক্লিয়াসের ভাঙন বা সংযোজন; এর ফলে এর বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বদলে যায়। নিউক্লিয়াসের ভাঙন ধরানো হয় যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, সেটাকে বলে নিউক্লিয়ার ফিশন। আজকের পারমাণবিক বোমা ও পারমাণ বিদ্যুৎ প্ল্যানে ব্যবহার করা হয় এই বিক্রিয়ায়।
নিউক্লিয়ার ফিশনের বীজও বোনা ছিল ফার্মির ৯৩তম মৌলটি উৎপন্ন করার মধ্যে। ১৯৩৪ সালে এ চেষ্টা ফার্মি প্রথম শুরুর করেন। ৩৯ সালে মোটামুটি নিশ্চিত হন তিনি ৯৩তম মৌলটি পেয়ে গেছেন। আগেই বলা হয়েছে ফার্মি যে ৯৩তম মৌলটা পেয়েছেন কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। এর কারণ, এই বিক্রিয়া ঘটানোর সময় ভারী কণার পাশাপাশি আরো কিছু পরমাণু দেখা যায়।
এই কণাগুলো যে কী তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানীদের। আইডা নোড্যাক ট্যাকে, যিনি ইউরেনিয়ামের অন্যতম আবিষ্কারক, তিনি বললেন, নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস ভেঙে পচুনিয়াম তৈরি হবে, সব সময় এমনটা না-ও হতে পারে। ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস বেশ বড় আর জটিল। তাই একটি নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে একে আরো বড় নিউক্লিয়াসে পরিণত করার চেয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলার কাজটা বরং বেশি সহজ। ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া আমরা যে নানা রকমের কণা দেখতে পাচ্ছি, এর অন্য একটা মানে থাকতে পারে। সম্ভবত ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেই ছোট ছোট টুকরোগুলো আসলেই বিভিন্ন মৌলের নিউক্লিয়াস। সম্ভবত নোডাকের আগের দুর্নামের কারণে অন্য বিজ্ঞানীরা তাঁর এ কথায় কর্ণপাত করেননি। যদি সত্যি সত্যি কণা পদার্থবিজ্ঞানীরা তার কথায় গুরুত্ব দিতেন, তাহলে অন্য রকম ফল পাওয়া যেত সে বছরই।
১৯৩৭ সাল। জার্মানিতে তখন নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে গবেষণা করছেন পারমাণবিক বোমার অন্যতম জনক অটোহ্যান। তার সহযোগী লিজ মিটনার।
নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামকে আঘাত করলে একটা আলফা কণা নির্গত হয়। কিন্তু অটোহ্যান বললেন, শুধু কি একটা আলফা কণা নির্গত হয়, নাকি দুটোও হতে পারে। ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৯২। দুটো আলফা কণার পারমাণবিক সংখ্যা ৪। সুতরাং নিউক্লিয়াস থেকে চারটি আলফা-কণা বেরিয়ে গেলে পারমাণবিক সংখ্যা হবে ৮৮। রেডিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৮৮। তাহলে নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস রেডিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হতে পারে। শুধু বললেই তো হবে না, প্রমাণ তো দেখাতে হবে। সেই কাজটিতেই তিনি হাত দিলেন মাইটনারকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁরা দেখলেন, স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয় ভাঙনের ফলে ইউরেনিয়াম থেকে যে পরিমাণ রেডিয়াম পাওয়া যায়, নিউটনের আঘাতের ফলে যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, তাতে রেডিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। কতটা বেশি কিংবা আদৌ বেশি কি না সেটা গুণে দেখতে না পারলে অটোহ্যানের প্রস্তাব প্রমাণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং পরীক্ষা-পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
মেরি আর পিয়েরি কুরি দেখিয়েছিলেন, কিভাবে ইউরেনিয়াম থেকে রেডিয়াম আলাদা করতে হয়। কিন্তু তাঁদের কাছে ছিল ভূতত্ত্ববিদ বন্ধুর দেওয়া টনকে টন ইউরেনিয়াম আকরিক। অটোহ্যান আর মাইটনারেরা চাইলেও সেই পরিমাণ ইউরেনিয়াম আকরিক হয়তো জোগাড় করতে পারতেন। কিন্তু খনিতে পাওয়া ইউরেনিয়াম আকরিকে কাজ হতো না। এটা স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা নয়, রীতিমতো নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটাতে হবে। সে জন্য চাই বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম। টনকে টন বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম গোটা দুনিয়া চষেও পাওয়া মুশকিল। সুতরাং অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই সীমাবদ্ধতা মেনেই করতে হবে পরীক্ষা। ধরতে হবে অন্য পথ। পর্যায় সারণিতে রেডিয়ামের অবস্থান বেরিয়ামের ঠিক এক ধাপ নিচে। একই কলামে কিন্তু পরের সারিতে রেডিয়াম বসে। আর পর্যায় সারণির নিয়মানুযায়ী একই কলামের বিভিন্ন সারির পরমাণুগুলোর মধ্যে পারমাণবিক সংখ্যার পার্থক্য যতই হোক, এদের ধর্মে ও বৈশিষ্ট্যে অনেক মিল। রেডিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৮৮ এবং বেরিয়ামের ৫৬। পর্যায় সারণিতে মৌলের আচরণ ও ধর্ম কাছাকাছি। তাই রেডিয়ামকে ধরতে তৈরি করতে হবে বেরিয়ামের ফাঁদ।
তখন অটোহ্যান একটা বুদ্ধি বের করলেন। নিউট্রনের আঘাতে ভেঙে যাওয়া ইউরেনিয়ামকে এসিডে দ্রবীভূত করতে চান অটোহ্যান। দ্রবীভূত করার সময় তার সঙ্গে যোগ করা হবে স্থিতিশীল বেরিয়াম।
পরে আবার দ্রবণ থেকে রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে আলাদা করা যাবে সেই বেরিয়াম। তবে তেজস্ক্রিয় বেরিয়াম হয়ে বের হবে। তেজস্ক্রিয় বেরিয়াম আলাদা করার সময় এর সঙ্গে রেডিয়ামও আলাদা করা সম্ভব হবে। কিভাবে?
যেহেতু রেডিয়াম আর বেরিয়ামের ধর্ম কাছাকাছি। তাই যে পদ্ধতিতে এসিডের দ্রবণে বেরিয়াম পাওয়া যাবে, সেই একই রকম আচরণের কারণে রেডিয়ামকেও আলাদা করা সম্ভব হবে। তাই যদি হবে, তাহলে আলাদা করে আবার স্থিতিশীল রেডিয়াম যোগ করা হলো কেন এসিড দ্রবণে? ইউরেনিয়াম থেকে তো এমনিতেই কিছু বেরিয়াম পাওয়া যেত!
না, যেত না। অটোহ্যান বলেছিলেন, নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম থেকে শুধু রেডিয়ামই বের হবে, বেরিয়াম নয়। কিন্তু এসিড থেকে রেডিয়াম নিষ্কাশনের পদ্ধতি তখনো অজানা। কিন্তু বেরিয়াম নিষ্কাশনের পদ্ধতি হ্যানের জানা ছিল। অনেকটা কাছাকাছি চরিত্রের বলে এসিড থেকে বেরিয়াম আলাদা করার সময় একই সঙ্গে রেডিয়ামও আলাদা হয়ে যাবে। তখন রেডিয়াম আর বেরিয়ামের সেই মিশ্রণ থেকে রেডিয়াম আলাদা করা খুব কঠিন কাজ হবে না।
এই ছিল অটোহ্যানের পরিকল্পনা। পরীক্ষার আয়োজনের কথা যখন ভাবছেন, ঠিক তখন মাইটনারকে জার্মানি ছাড়তে হলো। কারণ তাঁর পারিবারিক ধর্ম ইহুদি। হিটলারের ইহুদি রোষ তখন চরমে উঠেছে। মাইটনারের নিজের দেশ অস্ট্রিয়াও আক্রান্ত নাৎসি থাবায়। সুতরাং মাইটনার লুকিয়ে নেদারল্যান্ডে পাড়ি জমান।
হানের তখন আরেকজন করিৎকর্মা সহকারী দরকার। পেয়েও গেলেন। অ্যাটোহ্যানের সঙ্গে একযোগে যার নাম উচ্চারিত হয় নিউক্লিয়ার ফিজিকসে, সেই ফ্রিত্জ স্ট্রেসম্যান যোগ দিলেন হ্যানের সহকারী হিসেবে। তাঁকে নিয়েই অটো হ্যান পরীক্ষাটি শুরু করলেন। পরীক্ষার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলো ঠিকঠাকভাবে। হান আর স্ট্রেসম্যান এসিড দ্রবণ থেকে বেরিয়াম আলাদা করতে সক্ষম হলেন।
বিজ্ঞানীদ্বয় ধরেই নিলেন বেরিয়ামের সঙ্গে রেডিয়ামও আছে। তারা হিসাব করে বেরও করে ফেললেন, কী পরিমাণ রেডিয়াম পাওয়া যাবে সেই মিশ্রণ থেকে, সেই পরিমাণটাও। কিন্তু আসল কাজটাতেই ব্যর্থ হলেন হ্যান-স্ট্রেসম্যান। তাঁরা নানা উপায়ে বেরিয়াম থেকে রেডিয়াম আলাদা করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সামান্য পরিমাণ বেরিয়ামও পেলেন না। তখন সন্দেহ হলো অটোহ্যানের। ভাবলেন, তাঁর আগের অনুমান ভুল ছিল। নিশ্চয়ই নিউট্রনের আঘাতে ভাঙচুর হওয়া ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস রেডিয়ামে পরিণত হয় না। তাহলে এটা কী? হ্যান, তখন বললেন শুধুই বেরিয়াম উৎপন্ন হচ্ছে ইউরেনিয়ামের বিক্রিয়ায়। কিন্তু সেই বেরিয়াম সাধারণ বেরিয়াম নয়। ওটা আসলে বেরিয়ামের একটি আইসোটপ।
অটোহ্যানের নতুন এই ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে একটা সমস্যা দেখা দেয়। নিউট্রনের আঘাতে যে ইউরেনিয়ায়িমের নিউক্লিয়াসে ভাঙন ধরছে, সেটা ছোটখাটো ভাঙন নয়। কারণ, একটা আলফ কণা বেরিয়ে গেলে এর ভরসংখ্যা কমবে ২। তখন সেটা পরিণত হবে থোরিয়ামে। আর যদি দুটি বের হয়, তাহলে তখন সেটা রেডিয়ামে পরিণত হবে। আর যদি কমে যায় তিনটি আলফা কণা, তাহলে পারমাণবিক সংখ্যা ছয় কমে দাঁড়াবে ৮৬-তে। অর্থাৎ নতুন নিউক্লিয়াসটি হবে রেডনের। কিন্তু বেরিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা মাত্র ৫৬, অন্যদিকে ইউরেনিয়ামের ৯২। পারমাণবিক সংখ্যার ব্যবধান ৩৬! ইউরেনিয়ামকে যদি বেরিয়ামে পরিণত হতে হয়, তাহলে এর থেকে ১৮টি আলফা কণা বেরিয়ে যেতে হবে! সেটা কি সম্ভব?
সম্ভব কি না সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার। কিন্তু অটোহ্যান নতুন ধারণা নোডাক আইডার ধারণাকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ নিউক্লিয়াস দুটো বড় টুকরোয় ভাগ হয়ে যাবে। যার একটি হবে বেরিয়াম ৫৬-এর, আরেকটি হবে ১৮ আলফা কণার সমান। অর্থাৎ সেটার পারমাণবিক সংখ্যা হবে ৩৬। কিন্তু নতুন ধারণটা সে সময়ের জন্য অবিশ্বাস্য ছিল, কারণ সামান্য একটা নিউট্রন কণার আঘাতে এত বড় একটা নিউক্লিয়াসে এত বড় ভাঙন ধরবে, এ কথা মেনে নেওয়ার মতো বিজ্ঞানী কমই ছিলেন। তাই হ্যান কথাটা পাঁচকান হতে দেননি।
ওদিকে ডেনমার্কে বসে গুরু অটোহ্যানের ব্যর্থতার খবর পেয়েছিলেন লিজ মাইটনার। কিন্তু হ্যানের নতুন ধারণার খবর তিনি জানতেন না, তবু তিনি গুরুর মতোই ধারণা করেছিলেন, নিশ্চয়ই নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস দুটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো নেহাত একটা বা দুটো আলফা কণার সমান নয়। এ বিষয়ে তিনি একটা চিঠি লেখেন। সেটা পাঠান বিখ্যাত নেচার পত্রিকায়।
একই চিঠির আরেকটা কপি পাঠান কোপেনহেগেনে তাঁর ভাইপো অটো রবার্ট ফ্রিশের কাছে। ফ্রিশ তখন কাজ করছেন বোরের গবেষণাগারে। মাইটনার ভাইপোকে চিটিঠা লিখেছিলেন নীলস বোরকে দেওয়ার জন্য। ওদিকে অটোহ্যানও বোরকে মান্য করতেন। তিনিও তাদের গবেষণার কথা বোরকে জানান। সেটা ১৯৩৯ সালের কথা। এসব তথ্য নিয়েই নীলস বোর সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিলেন।
মাইটনার ভাইপো ফ্রিশকে নিয়ে একটা পরীক্ষাও করে ফেলেছেন। একটা আয়নিত চেম্বারে ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে দুটুকরো করতে সক্ষম হয়েছেন ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে। এটাই ছিল নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ার প্রথম পরীক্ষার প্রমাণ।
এখানে আরেকটা প্রশ্ন কিন্তু বড় হয়ে দেখা দেয়। এনরিকো ফার্মি যখন ইতালিতে বসে গবেষণা করছিলেন সহকর্মীদের নিয়ে, তখন নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে আঘাত করার কথা তো তিনিই বলেছিলেন, প্রথম পরীক্ষাটা তো তাঁরাই করেছিলেন। তাহলে তাঁরা কেন ফিশন বিক্রিয়ার সন্ধান পেলেন না?
তারাই আগে পেতেন যদি না, তারা পরীক্ষাটাকে একটু অন্যভাবে করতেন। পুরো ব্যবস্থাটিকে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পারে ভেতর মুড়ে করেছিলেন ফার্মিরা, যাতে নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত আলফা কণা বেরিয়ে যেতে না পারে। তাছাড়া এনরিকো ফার্মি তাঁর পরীক্ষাগুলো করেছিলেন প্যারাফিন এর ভেতর দিয়ে শ্লথ হয়ে আসা নিউট্রন ব্যবহার করে। শ্লথ নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়াম-২৩৮-এর ফিশন বিভাজন সম্ভব নয়।
চেইন বিক্রিয়া
১৯৩৯ সালের দিকেই নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেল। তখন নীলস বোর বুড়ো হাড়ে আবার ভেলকি দেখালেন। হিসাব কষে দেখিয়ে দিলেন, চাইলেই নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম-২৩৮-এর নিউক্লিয়াসের ফিশন ঘটানো সম্ভব নয়। এর জন্য যে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হবে, তার শক্তি হতে হবে কমপক্ষে ১ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট। অবশ্য শ্লথ নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামের ফিশন ঘটানোর একটা উপায় বাতলে দিলেন বোর। বললেন, নিট্রনের গতিশক্তি যদি কম হয়, তাহলে ব্যবহার করতে হবে ইউরেনিয়ামের আরেকটা আইসোটোপ- ইউরেনিয়াম ২৩৫। কিন্তু এখানেও লুকিয়ে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। দেখা যায়, যে জিনিস সহজলভ্য তা কাজের নয়, যা দুষ্প্রাপ্য তা সহজে কাজ করে। ইউরেনিয়াম ২৩৫ দুষ্প্রাপ্য।
কথা হলো, বোরের এই নতুন তত্ত্ব কি ঠিক? ঠিক কি না প্রমাণ করতে সময় লাগল না। মার্কিন বিজ্ঞানী আলফ্রেড অটো কার্ল নিয়ার ও জন রে ড্যানিং পরীক্ষাগারে প্রমাণ করলেন বোরের তত্ত্ব নির্ভুল।
বোর যখন যুক্তরাষ্ট্রে, তখন আরেক হাঙ্গেরিয়ান-মার্কিন বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড নিউক্লীয় বোমার স্বপ্নে মশগুল। সব বিজ্ঞানীর মানসিকতা এক নয়, কেউ মানবতার জয়গান করেন, কেউ বা বিজ্ঞানকে দেখেন প্রতিপক্ষকে ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে। জিলার্ড কি দ্বিতীয়দের দলে? জিলার্ডের জন্ম ইহুদি পরিবারে। তাই হিটলারের রোষ তার ওপরেও পড়েছিল। বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাই হয়তো হিটলারের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্মেছিল তাঁর মনে। চেয়েছিলেন পারমাণবিক বোমা তৈরি করে শায়েস্তা করবেন হিটলারকে। ওদিকে খবর রটেছিল, হিটলার নাকি নিউক্লীয় বোমা তৈরির খুব কাছাকাছি চলে গেছেন। সুতরাং মার্কিন বিজ্ঞানীরাও তখন রীতিমতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, হিটলারক যদি মোকাবেলা করতে হয় তাহলে নিউক্লিয়ার বোমার বিকল্প নেই।
জিলার্ড বোরের কাছ থেকেই শুনলেন অটোহ্যানের ধারণার কথা, শুনলেন স্ট্রেসম্যানের সঙ্গে করা হ্যানের ব্যর্থ পরীক্ষার কথাও। অটোহ্যানের নতুন ধরনের কথা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুতরাং জিলার্ড ভাবলেন, স্বপ্নপূরণের খুব কাছে চলে এসেছেন তিনি। নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে সত্যি যদি ইউরোনিয়াম নিউক্লিয়াসকে দুই টুকরো করা যায়, তাহলে বিপুল পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত হবে। কিন্তু এই শক্তি দিয়ে কি বোমা বানানো সম্ভব?
একবার নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সংঘটিত হয়েই যদি ফিশন বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, এ রকম বিক্রিয়া দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করে খুব বেশি লাভ হবে না। জিলার্ডের মাথায় খেলে যাই নতুন বুদ্ধি। তিনি একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করলেন। তিনি একটা সিস্টেমের কথা ভাবলেন। সিস্টেমে একটা নিউট্রন গিয়ে আঘাত করবে একটা নিউক্লিয়াসকে। ফলে নিউক্লিয়াস থেকে মুক্ত হবে দুটি নিউট্রন। সেই দুটি নিউট্রন গিয়ে আবার আঘাত করবে আরো দুটি নিউক্লিয়াসকে। ফলে নতুন দুই নিউক্লিয়াস থেকে চারটি নিউট্রন নির্গত হবে। সেই চারটি নিউট্রন নতুন চারটি নিউক্লিয়াসকে আঘাত করবে। ফলে বেরিয়ে আসবে আটটি নিউট্রন। সেই আট নিউট্রনের আঘাতে মুক্ত হবে ষোলোটি নিউট্রন। এভাবে নিউট্রন মুক্ত হয়ে আরো বেশি নিউক্লিয়াসকে আঘাত করবে। ফলে একটা চেইন বিক্রিয়া তৈরি হবে, সেই বিক্রিয়ায় ক্রমাগত নতুন নতুন ফিউশন বিক্রিয়া ঘটবে। এবং প্রতিবার আঘাতেই প্রচুর পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত হবে। সেই শক্তি দিয়ে ধ্বংস করা যাবে বিরাট বিরাট শহর। ভাবনাটা যুগান্তকারী, কিন্তু বাস্তবতা অত সহজ ছিল না। এটাই ছিল নিউক্লিয়ার চেইন রিঅ্যাকশনের মূলনীতি। এর ভিতটা জিলার্ল্ড গড়লেও এ ধরনের বিক্রিয়ার কথা প্রথম বলেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী আর্নেস্ট অগাস্ট বোদেনস্টাইন। সেটা ১৯১৩ সালের কথা। তখন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়নি, চেইন বিক্রিয়া অনেক দূর-অস্ত। তাই বোদেনস্টাইনের প্রস্তাব হালে পানি পায়নি।
জিলার্ড ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কেইম ওয়েইজম্যানকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকবার চেইন বিক্রিয়া প্রস্তুত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলো সব প্রচেষ্টা। জিলার্ড দেখলেন, ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস উচ্চগতির নিউট্রন দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যে দুটি নিউট্রন ছেড়ে দিচ্ছে, সেগুলোর শক্তি এতই কম যে এদের দিয়ে নতুন নিউক্লিয়াসে আঘাত করানো সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় সে কথা বোর আগেই বলে দিয়েছিলেন। জিলার্ড ইউরেনিয়াম ২৩৮ নিয়ে এই বিক্রিয়া করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বোর বলেছিলেন ২৩৫ ইউরেনিয়াম নিয়ে পরীক্ষা করলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। জিলার্ড তখন ইউরেনিয়াম ২৩৫ নিয়ে পরীক্ষা করলেন এবং দেখলেন যে ধীর গতির নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে ইউরোনিয়াম ২৩৫-কে ভেঙে ফেলা যায়। এ বিক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম ২৩৫ নিউক্লিয়াস আঘাতকারী নিউট্রনকে সঙ্গে নিয়ে খুব অল্প সময় এর জন্য ইউরেনিয়াম ২৩৬ আইসোটোপ তৈরি করে। এই আইসোটোপের আয়ু খুব-খুব কম। মুহূর্তের মধ্যেই ইউরেনিয়াম ২৩৬ ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়। আসলে দুটুকরো বলা ভুল। দুটো বড় বড় হবে টকুরো হবে আর সঙ্গে তিনটি নিউট্রন মুক্ত হবে। বড় দুটো টুকরোর একটি ক্রিপটন ৯২, আর অন্যটি বেরিয়াম ১৪১।
এখানে যে তিনটি নিউট্রন মুক্ত হচ্ছে, সেগুলো গিয়ে আবার তিনটি আস্ত ইউরেনিয়াম ২৩৫ নিউক্লিয়াসে আঘাত করে তিনটি নতুন বিক্রিয়া সংঘটিত করবে। সেই নতুন বিক্রিয়া থেকে আবার ৯টি নিউট্রন মুক্ত হবে। সেই নয়টি নিউট্রন আবার নয়টি নতুন বিক্রিয়া শুরু করতে পারবে। চেইন বিক্রিয়াকে আগে যেমন মনে হচ্ছিল, একটা থেকে দুটো নিউট্রন তৈরি হবে- বাস্তবে দেখা গেল, দুটো নয় তিনটি নিউট্রন মুক্ত হচ্ছে। সুতরাং আরো বেগবান হচ্ছে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া।
শুধু কি ইউরেনিয়াম ২৩৫ ই চেইন বিক্রিয়া করতে পারে? নাকি আরো কোনো পরামানু আছে নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া করার মত। শিগগিরই দেখা গেল প্লুটোনিয়াম একটি আইসোটোপ দিয়ে আরো ভালোভাবে চেইন বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব।
ইউরেনিয়াম সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক মৌল। অন্যদিকে প্লুটোনিয়াম ল্যাবরেটরীতে তৈরি হয়। কথা হচ্ছে, এই প্লুটোনিয়াম কীভাবে ব্যবহার করা যায়?
আগেই বলা হয়েছে, ইউরেনিয়াম ২৩৫ দুষ্প্রাপ্য। অন্যদিকে ইউরেনিয়াম ২৩৮ সহজেই মেলে। কিন্তু ইউরেনিয়াম ২৩৮-কে দিয়ে চেইন বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব নয়। তখন বের হলো নতুন বুদ্ধি। যেহেতু প্লুটোনিয়াম সহজেই চেইন বিক্রিয়া ঘটাতে পারে, তাহলে এই জিনিসটাকে বেশি করে উৎপন্ন করা যেতে পারে। ইউরেনিয়াম ২৩৮-কে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করে নেপচুনিয়াম ২৩৯ তৈরি করা সম্ভব। নেপচুনিয়ামকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটা আলফা-কণা দিয়ে আঘাত করলে প্লুটোনিয়াম পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই প্লুটোনিয়াম হতে হবে ২৩৯ ভর সংখ্যার।
চেইন বিক্রিয়াই পারমাণবিক বোমার মূল চাবিকাঠি, একথা বুঝতে আর কারো বাকি রইল না বিজ্ঞানীদের। কিন্তু সেটা কি তৈরি সম্ভব। সম্ভব যদি ইউরেনিয়াম ২৩৫-কে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। কিংবা তৈরি করা যায় প্লুটোনিয়াম ২৩৯। ১৯৪১ সালে সেগ্রের নেতৃত্বে বার্কলের কণাবিজ্ঞানীরা সাইক্লোট্রনে এক মাইক্রো গ্রাম প্লুটোনিয়াম ২৩৯ তৈরি করতে সমর্থ হলেন।
নিউক্লিয়ার বোমা থেকে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় তাপ আকারে। আর সেই তাপশক্তি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়, মানুষ, ঘর-বাড়ি, শহর-নগরকে।