নদীবেষ্টিত জেলা মুন্সিগঞ্জ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারী যাত্রীবাহী সব লঞ্চ এই জেলার ধলেশ্বরী ও মেঘনা নৌপথ হয়ে রাজধানীতে যাতায়াত করে। অন্যান্য নদীতেও বিভিন্ন নৌযানের চলাচল দিনরাত্রি। যে কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচলে মুন্সিগঞ্জের নদীপথ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ এসব নৌপথে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থামছে না সূর্যাস্তের পর বালুবাহী বাল্কহেডের চলাচল। এতে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা, বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জে পদ্মার শাখা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় পিকনিকের ট্রলার ডুবে ১০ জন নিহত হওয়ার পর আবারো আলোচনায় এসেছে এই নৌযান। ওই দুর্ঘটনায় নিহত ৯ জনের মরদেহ পাওয়া গেলেও এক শিশুর মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত বালুবাহী বাল্কহেড ছয় হাজার ৩৭৯টি। যার মধ্যে রুট পারমিট রয়েছে মাত্র ১ হাজার ১৫০টির। তবে বাস্তবে নৌপথে এর কয়েকগুণ বেশি বাল্কহেড দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বাল্কহেডের মাস্টার, চালক, সুকানিদের অধিকাংশেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সনদ নেই। এছাড়া রয়েছে ফিটনেসসহ নানা সমস্যা। দেখে দেখে শিখে অনেকেই চালাচ্ছেন এসব নৌযান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নৌপথে রাতে বাল্কহেড চলাচলের নেপথ্যে রয়েছে আরেক অপরাধ কাহিনি। মুন্সিগঞ্জের মেঘনা ও পদ্মা নদীর শাখার বিভিন্ন স্থানে বালু লুটের আয়োজন হয় সন্ধ্যা নামলেই। অবৈধ ড্রেজারের মাধ্যমে নদী থেকে অপরিকল্পিভাবে কাটা হয় বালু। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে সেই বালু বাল্কহেডে পাচার হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিষয়টি যেন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
মুন্সিগঞ্জ সংলগ্ন পদ্মায় এমন বালু লুটের প্রতিবাদে সম্প্রতি নদীতে ট্রলারবহর নিয়ে নৌ র্যালি করেন মুন্সিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। এরপরও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় আটক, জব্দের তথ্য পাওয়া গেলেও সেই পুরোনো চিত্রে ফিরতে তা বেশিদিন সময় লাগে না। এই চক্রের পেছনে রয়েছে বালুখেকো প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া। যে কারণে আইন প্রয়োগ করেও বন্ধ হচ্ছে না রাতে বাল্কহেড চলাচল।
সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরীতে চলাচলকারী বাল্কহেডগুলোতে আকার অনুযায়ী ৫ থেকে ১৫ হাজার ঘনফুট বালু ধারণ করা হয়। ড্রেজার ব্যবসায়ীরা এসব বালু বিক্রি করেন ঘনফুটপ্রতি ২ থেকে আড়াই টাকায়। বাজারে যে বালু ক্রয় করতে হয় ৮-১০ টাকায়। অর্থাৎ বালু ও বাল্কহেডের চক্র এমন করেই হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এ চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে নৌ-পুলিশসহ বিভিন্ন দপ্তরের অসাধু কিছু কর্মকর্তার।
সরেজমিনে গত কিছুদিন জেলার বিভিন্ন নদীপথ ঘুরে দেখা যায়, রাতের বেলা বাল্কহেড চলছে। বিশেষ করে জেলা সদর ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলা সংলগ্ন পদ্মার শাখা খাল হয়ে মেঘনা নদীতে যাতায়াত করছে বাল্কহেড। আনলোড থাকা অবস্থায় এসব বাল্কহেড দূর থেকে দেখা গেলেও বিপজ্জনক হয় যখন বালু বহন করে। সেসময় নৌযানটির অধিকাংশ অংশ পানিতে ডুবে থাকায় দূর থেকে বোঝারও উপায় থাকে না। নৌযানগুলোতে নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থাও। এতে রাতের অন্ধকারে দূর থেকে বোঝার উপায় থাকে না বাল্কহেডের গতিবিধি।
বেড়েই চলছে দুর্ঘটনা
মুন্সিগঞ্জের নৌপথে রাতে বাল্কহেড চলাচলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
গত ৫ আগস্ট রাতে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মা শাখা তালতলা-গৌরগঞ্জ নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় ৪৬ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় একটি পিকনিকের ট্রলার। এতে মৃত্যু হয় নারী-শিশুসহ ট্রলারে থাকা ১০ যাত্রীর। এ ঘটনায় ঘাতক বাল্কহেড সংশ্লিষ্টদের আসামি করে মামলা করেন নিহত এপি ও পপির বড় ভাই রুবেল।
এর আগে গত বছর ২৬ মার্চ ভোরে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটের অদূরে লঞ্চের ধাক্কায় পাঁচ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পাবনাগামী সিমেন্টবাহী বাল্কহেড। ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় মুন্সিগঞ্জ সংলগ্ন মেঘনা নদীর চরকিশোরগঞ্জ এলাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি সুরভী-৭ এর সঙ্গে ধাক্কায় ডুবে যায় ডেমরাগামী একটি বাল্কহেড। এ দুর্ঘটনায় লঞ্চের সামনের অংশ ছিদ্র হলে পাড়ে নোঙর করে প্রাণে রক্ষা পান যাত্রীরা। তবে নিহত হন ডুবে যাওয়া বাল্কহেডটির শ্রমিক মোতালেব হোসেন (৫৫)।
এছাড়া ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর ধলেশ্বরী ও মেঘনার মোহনায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ও কয়লা বহনকারী বাল্কহেডের সংঘর্ষে ৯ শ্রমিক আহত হন। এর কিছুদিন পর রাতের বেলা বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে কাঠপট্টি লঞ্চঘাটের অদূরে ধলেশ্বরী নদীতে বরগুনাগামী এমভি মানিক-৯ লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌ-রুটের ধলেশ্বরী নদীতে লঞ্চ ও বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষে লঞ্চের এক যাত্রী নিহত ও পাঁচজন আহত হন।
২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সদর উপজেলার চর আবদুল্লাহপুর গ্রাম সংলগ্ন মেঘনা নদীতে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌ-পুলিশের ট্রলারডুবির ঘটনায় এক কনস্টেবল নিহত হন। ৩০ এপ্রিল মেঘনা নদীতে ঢেউয়ের কবলে পড়ে ইটবোঝাই ট্রলারডুবিতে রফিজ উদ্দিন মিয়া নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ১৮ আগস্ট মেঘনা নদীর মোহনায় গ্রিনলাইন-২ লঞ্চের ঢেউয়ে ইটবাহী ট্রলার ডুবে ১০ শ্রমিক আহত হন।
এছাড়া ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে আরও প্রায় এক ডজন দুর্ঘটনা ঘটে রাতের বেলা বাল্কহেড চলাচলের কারণে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর গজারিয়া উপজেলার মেঘনা নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় বাল্কহেড ডুবিতে নিখোঁজ হন তিনজন। ২০২০ সালের ২০ জুলাই ভোরে মেঘনা নদীর ইসমানি চর এলাকায় মাস্টার, সুকানিসহ পাঁচজনকে নিয়ে ডুবে যায় একটি বালুবোঝাই বাল্কহেড।
এ বিষয়ে নৌ-পুলিশের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদা বলেন, মেঘনা নদীর কলাগাছিয়া, ধলেশ্বরীর মুক্তারপুর পয়েন্টসহ বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিনিয়ত কাজ করছে নৌপুলিশ। কিছুদিন আগেও বড় একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সূর্যাস্তের পর বৈধ কিংবা অবৈধ কোনো বাল্কহেড চলতে পারবে না।
কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো ফাঁড়ির কর্মকর্তাকে নিয়ে এমন অভিযোগ আমার কাছে নেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় একসঙ্গে পাঁচটি বাল্কহেড এসেছে সেক্ষেত্রে একটি ফাঁড়ির সদস্যরা দুটি আটক করেছে, একই রুটের পরের ফাঁড়ির সদস্যরা তিনটি আটক করেছে। এর কারণ হলো জনবলের। একসঙ্গে সবাইকে তো কোনো পুলিশ ফাঁড়ি আটক করতে পারবে না।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা জানান, বাল্কহেড চলাচলের ক্ষেত্রে সব কর্তৃপক্ষকেই নজরদারি রাখতে হবে। নৌপুলিশের দায়িত্বই মূল। এরপর কোস্টগার্ড আছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাতে বাল্কহেড চলাচল বন্ধ করতে হবে। অবৈধ বাল্কহেড বন্ধের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ই অভিযান চলে, জব্দ জরিমানা করা হয়। কিন্তু এসব নৌযানকে আটক করে রাখার মতো নদীতে জায়গা নেই। এসব সমস্যার সমাধান হলো কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, নজরদারি এবং যেখানে সমস্যা থাকবে সেগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ভোলা বন্দরে বেশকিছু অভিযান চালিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। গত জুলাইয়ে এবং ১ আগস্ট ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের মাধ্যমে ২৬টি বাল্কহেডকে জরিমানা করা হয়েছে। মেরিন কোর্টে মামলা হয়েছে ২৫টি বাল্কহেডের বিরুদ্ধে। জরিমানা করা হয়েছে ৩ লাখ ৩ হাজার টাকা। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।