এক সময়ে মানুষ একটু ফুরসত পেলেই বাঁশ-বেতের পাটি, খাঁচা, মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুড়ি, ডুলা, মোড়াসহ বিভিন্ন ঘরের কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র বানাতে বসে পড়তো। গ্রাম-বাংলায় এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না, বিলুপ্তির পথে এখন এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প। সাধারণত গ্রামের লোকেরাই বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে জড়িত। তাই এ শিল্পকে গ্রামীণ লোকশিল্প বলা হয়। কালের বিবর্তনে এবং প্রযুক্তির বদৌলতে পুরনো এ শিল্পের ঐতিহ্য আজ আমাদের মাঝ থেকে হারাতে বসেছে। তার স্থানে দখল করে নিচ্ছে প্লাস্টিক ও কাঠের তৈরি জিনিসপত্র। এর মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের কদর বেশি।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মোহলি সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো যুগযুগ ধরে মানবেতর জীবনযাপন করলেও কেউই তাদের খোঁজ রাখে না। বাঁশের তৈরি গৃহস্থালী সামগ্রী বানিয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা মোহলি সম্প্রদায়ের একমাত্র পেশা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তাদের তৈরি বাঁশের পণ্যের ন্যায় একই ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বাজার দখল করে নেয়ায় সীমিত হয়ে পড়েছে তাদের রোজগারের পথ। বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে শত বছরের পুরনো বাপ-দাদার হস্তশিল্পের পেশা। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কি.মি. পশ্চিমে সাপমারা ইউনিয়নের সাপমারা মৌজার ফাঁসিতলা-কামদিয়া সড়কের পাশে এ মোহলি পাড়ার অবস্থান। সরেজমিন গেলে মোহলি পাড়ার এক বাসিন্দা জানান, নিজস্ব মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির জাতিসত্ত্বার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বর্তমানে ২৫টি পরিবারের ১৫০ জন জনসংখ্যা অধ্যূষিত মোহলি পাড়ায় এক সময় সাড়ে ৪০০ পরিবার বসবাস করত।
চাষাবাদের জমি না থাকায় অভাবের কারণে তারা দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বসবাস করছে। তিনি জানান, বাঁশ দিয়ে কুটিরশিল্পের কাজ করার জন্য তাদের পরিচিতি হয়েছে মোহলি সম্প্রদায়। তাদের পরিবারের ছেলে-মেয়ে সবাই বাঁশ দিয়ে কুটিরশিল্পের কাজ করে। তিনি নিজেও কিশোর বয়স থেকে বাঁশ দিয়ে ডালি, কুলা, টোঁপা, খলই, ঝাঁকা, ডুলি, চালা, চালুন বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্য তৈরি করে আসছেন। যুগযুগ ধরে চলে আসা তাদের পৈত্রিক এ পেশার এক সময় বেশ কদর ছিল।
চাষাবাদের জমি না থাকলেও পৈত্রিক পেশায় তাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জুটত। কিন্তু বেশ কয়েক বছর থেকে তাদের পৈত্রিক পেশা হুমকির মুখে পড়েছে প্লাস্টিক পণ্যের বাজার দখল করে নেয়ার কারণে। ফলে এ শিল্প থেকে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কালের আবর্তে, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন বহু আগেই। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে বন-জঙ্গল উজাড়, বাঁশ-বেতের কম উৎপাদন, পুঁজি, উদ্যোগ ও পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পেশা পরিবর্তন করছেন এ শিল্পের কারিগররা। ধাতব ও প্লাস্টিক পণ্যের কবলে পড়ে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীনতম শিল্পটি ক্রমশ মুখ থুবড়ে পড়ছে।
যার ফলে ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির চরম দুর্দিন চলছে। এ দুর্দিন কাটিয়ে এ শিল্পের সুদিন ফিরিয়ে আনতে নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ। একদিকে বেত ও বাঁশের সংকটের কারণ ও অভাবের তাড়নায় এই শিল্পের কারিগররা দীর্ঘদিনের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ অনেকে অন্য পেশার দিকে ছুটে যাচ্ছে। শত অভাব-অনটনের মাঝেও এখনো কয়েকটি গ্রামে হাতেগোনা কয়েক পরিবার আজও পৈতৃক এই পেশাটি ধরে রেখেছেন।
তারা জানান, এক সময় গ্রাম এলাকায় প্রচুর বাঁশ-বেত পাওয়া যেতো। যার ফলে তাদের এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় ও থানায় (জেলা ও উপজেলা) শত শত মানুষ বাঁশ ও বেত শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন ধাতব ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার, প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বেত না পাওয়া, পুঁজি এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এ শিল্পের বেশিরভাগ মানুষ এ পেশাটি ছেড়ে দিয়েছেন।
যারা এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন, তাদের অনেকেই সরকারি-বেসরকারি কোন রকমের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই টিকে আছেন। বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি উৎপাদন করেও তা ন্যায্যমূল্যে বাজারে বিক্রি করতে না পারায় তাদের ঘরে অভাব অনটন লেগেই আছে। এতে প্রয়োজনের তুলনায় দৈনিক আয় কম হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছেন ।
বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে মোহলি পাড়ার আর এক বাসিন্দা জানান বাধ্য হয়ে অনেকে এ কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা বংশ পরম্পরায় এবং পূর্ব-পুরুষ থেকে চলে আসা এই পেশা আঁকড়ে ধরে রেখেছি। এখানে সরকারিভাবে কারো প্রশিক্ষণ নেই।
তিনি বলেন, আগে বড় ও মাঝারি সাইজের বাঁশ ৫০-১৫০ টাকায় কেনা যেতো। এখন ২০০-৩৫০ টাকায় কিনতে হয়। প্রায় দুইদিনের (১২+১২ ঘণ্টা) পরিশ্রমে একটি বড় বাঁশ দিয়ে ১০টি খাঁচা তৈরি করা যায়। আর প্রতিটি ৫০-৮০ টাকা করে ১০টি খাঁচা ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
এতে আমাদের পোষায় না। তবে পাইকাররা এইসব খাঁচা ২০০ টাকায় ও বিক্রি করে বলে জানা গেছে। এক সময়ে এ পেশার সাথে জড়িত থাকা এক পরিবার জানান, বাঁশের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাঁশের তৈরি পণ্যের দাম বাড়েনি। যার ফলে আমরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছিনা।
কারিগরদের দাবি সরকারি পৃষ্ঠ পোষকতা, সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা পেলে পুনরায় উজ্জীবিত হবে এ শিল্প। বাঁশ শিল্প কেন্দ্রিক সরকারি বেসরকারি উদ্যেগ গ্রহণে ভাগ্য বদল হতে পারে এ অঞ্চলের কারিগরদের। বিশেষজ্ঞদের ধারনা, সরকারী কোন সহায়তা পেলে হয়তো ফিরে পেতে পারে গ্রামগঞ্জের হারিয়ে যেতে বসা এই চিরচেনা গুরুত্বপুর্ন কারুকাজ শিল্পটি।
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন