বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় গত ২০ দিনে ৪ জন একই কায়দায় আত্মহত্যা করেছে। গত ২১মার্চ উপজেলার মাঝিহট্র ইউপির দামগাড়া কারিগর পাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল এর পুত্র সবুজের মৃত্যুর সূচনা দিয়ে ৯এপ্রিল শনিবার শিবগঞ্জ পৌর এলাকার বানাইল গ্রামের নীরবের মৃত্যুর রেশ দিয়ে ৪ জনে ঠেকেছে।
এদের মধ্যে ২ জন যুবক ও ২ জন স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। নিরাপদ নিউজ ডটকমের অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে জানা যায়, শনিবার ৯এপ্রিল বগুড়ার শিবগঞ্জে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে নীরব হাসান (১৬) নামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থী দুপুর ১টার দিকে তাদের বসতবাড়ীর ২য় তলায় তার শয়ন কক্ষে ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না জড়িয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
নীরব শিবগঞ্জ পৌর এলাকার বানাইল গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তার পুত্র। সে শিবগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
নীরব হত্যার বরাত দিয়ে শিবগঞ্জ থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) রুম্মান হাসান বলেন, প্রাথমিকভাবে নীরবের মৃত্যু রহস্যজনক মনে হচ্ছে। তার মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।
এদিকে গত (৬এপ্রিল) বুধবার বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় বানারশি গ্রামে রাতে গলায় ফাঁস দিয়ে আহসান হাবীব হিরু (১৬) নামের এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যা করে। নিহত হিরু গড়মহাস্থান বানারশি গ্রামের আব্দুল হান্নানের পুত্র। সে গোকুল তছলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, হিরু বুধবার সন্ধ্যায় নিজ কক্ষের দরজা বন্ধ করে গলায় চাদর পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
পরিবারের সদস্যরা পরে ইফতারির জন্য ডাকাডাকি করলে তার কোন সাড়া শব্দ পায় না। একপর্যায়ে কক্ষের বিপরীত একটি দরজা খুলে দেখতে পায় তার ঝুলন্ত মরদেহ। তাৎক্ষণিক উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের সংবাদ পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দীপক কুমার দাস (পিপিএম)। তিনি নিহতের বরাত দিয়ে জানান, ‘মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (শজিমেক) মর্গে রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।’
গত ২৭ মার্চ বগুড়ার শিবগঞ্জে নেশার টাকা না পেয়ে শয়ন কক্ষে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যাকারী রায়হান(২৫) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিবগঞ্জ পৌর এলাকার বানাইল গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আত্মহত্যাকারী যুবক রায়হানের পিতার নাম আফতাব হোসেন।
আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করেন, শিবগঞ্জ থানার এসআই নাছির উদ্দীন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রায়হান ২বছর যাবৎ নেশায় আসক্ত ছিল। সে মাদকাসাক্ত হওয়ায় তার স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের সাথে মাঝে মধ্যেই নেশার টাকা নিয়ে ঝগড়া বিবাদ হতো। সে গত ১ মাস যাবৎ স্ত্রী মুন্নিসহ তার শশুর বাড়ি রায়নগর ইউনিয়নের দক্ষিণকৃষ্ণপুর গ্রামে বসবাস করতেন। রায়হান নেশা করতে না পেয়ে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে।
রায়হানের মা জাহানারা বেগম বলেন, আত্মহত্যার ২ দিন পূর্বে সে আমার কাছে আগের মতই নেশার টাকা চাইতে থাকে। তাকে শান্তনা দিয়ে অনেক কথা বললেও সে পাগলামো করতো।
২৭ মার্চ রবিবার সকাল ৭টার দিকে তাকে শয়নঘর থেকে ডাকতে গেলে সে সাড়া দেয়। পববর্তিতে তাকে দুপুর ১টার দিকে খাবারের জন্য ডাকতে গেলে তার কোন সাড়া শব্দ না পেলে প্রতিবেশীদের সহযোগীতায় শয়ন কক্ষের দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখা যায় রায়হান সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ নেই বলেও জানান রায়হানের মা জাহানারা বেগম।
এবিষয়ে শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দীপক কুমার দাস বলেন, আত্মহত্যার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। মরদেহের সুরতাহাল প্রতিবেদন তৈরী করে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। পরে ময়নাতদন্তের জন্য বগুড়া শজিমেকে এর কার্যক্রম শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে গত ২১মার্চ একই উপজেলার মাঝিহট্ট ইউনিয়নের মাসিমপুর চালুঞ্জা ও সৈয়দ দামগাড়া গ্রামে নবদম্পতির আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। আত্মহত্যাকারিরা হলেন চালুঞ্জা তালুকদার পাড়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক এর মেয়ে মার্জিয়া জান্নাত (১৮) ও দামগাড়া কারিগর পাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল এর পুত্র সবুজ(২০)।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ২১ মার্চ মাঝিহট্ট ইউনিয়নের চালুঞ্জা তালুকদার পাড়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক এর মেয়ে মার্জিয়া জান্নাত (১৮) ও দামগাড়া কারিগর পাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল এর পুত্র সবুজ(২০) প্রেম করে বিয়ে হয়। বিষয়টি মেয়ের পরিবার জানতে পেরে ছেলের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় মেয়ের পরিবার সেটা মেনে না নিয়ে মেয়েকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যায়। পরে প্রেমিকা মার্জিয়া তার নিজ বাড়ীতে বিষপানে আত্মহত্যা করে।
এ সংবাদ পেয়ে প্রেমিক সবুজ তার নিজ কক্ষের তীরের সাথে গলায় ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে পাঠায়।
উঠতি বয়সে শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২০ দিনে ৪ জন একই ভাবে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন, এবিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, অন্যান্য রাষ্ট্রে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। যেমন শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নেপাল। সেগুলোর কারণ
ঋণ গ্রস্ত ও দারিদ্রতা। আর আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে তরুন কিশোর কিশোরীদের আত্মহত্যার কারণ আমোদিতর অভাব ও অতিরিক্ত জেদ। এছাড়া সামাজিক ভাবে হেয় করা, অবজ্ঞা ও অবহেলা করা। সেই সাথে নেই খেলার মাঠ। নেই সাংস্কৃতিক চর্চা।
তার মতে, নির্যাতিত কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য দুর্বল থাকে আর তাদের আত্ম নিপীড়নের হারও থাকে বেশী। পাশাপাশি পারিবারিক ভাবে অসহনীয় মানসিক নির্যাতন আত্মাহত্যার দিকে ধেয়ে নিয়ে যায়।