নওগাঁ প্রতিনিধি: গ্রাম বাংলার যে কোনো উৎসবেই বাঙালির একটা বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে পিঠা-পুলি। তালের পিঠা দিযে অতিথি আপ্যায়ের রেওয়াজ বরেন্দ্র অঞ্চলের আজকের নয় বহু যুগ থেকেই চলে আসছে। যদিও উৎসবের রং চেহারা আগের চেয়ে অনেকটাই বদলে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আজো প্রাচীন ধারাকে ধরে রেখেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ।
প্রবাদে আছে ভাদ্রের গরম মানেই তাল পাকা গরম! সেই তালেই কত কি না কি তৈরী করা যায়। তালের বড়া বাঙালির রসনায় এক লোভনীয় খাবার। তাল দিয়ে তৈরী হয় নানান রসালো স্বাদের পদ। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এই তাল গাছ থেকে অনেকটাই দূরে। আর তাই সংস্কৃতি সচেতন মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজন করেন তাল পিঠা উৎসব।
এ রকম একটি আয়োজন করা হয় বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র নওগাঁতে। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার হাজিনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙ্গা তালতলিতে (তালসড়ক) শনিবার দিনব্যাপী তাল পিঠা মেলার আয়োজন করে নিয়ামতপুর উপজেলা পরিষদ। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক আয়োজন।
শনিবার ছুটির দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাল পিঠা মেলা ঘিরে জমজমাট পরিবেশ দেখা যায় উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গা তালতলী সড়কে। সারি সারি তালগাছের মনোরম সৌন্দর্যের সড়কটিকে পর্যটকদের কাছে পরিচিত করতে গত বছর থেকে তাল পিঠা উৎসবের আয়োজন করে আসছে নিয়ামতপুর উপজেলার পরিষদ।
আয়োজকরা জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ধশতাধিক সংঠন ও প্রতিষ্ঠান পিঠা উৎসবে অংশ নেয়। উৎসবের আয়োজন যেমন ব্যাপক তেমনি পিঠার সম্ভারও ছিল বৈচিত্রময়। প্রায় ৩০ ধরণের তাল পিঠা ছাড়াও বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে বানানো অর্ধশতাধিক রকমের পিঠা সমাহার আসে উৎসবে। তাল দিয়ে তৈরি জামাই পিঠা, তালক্ষীর, পাকান, পুলি, কানমুচুরি, হৃদয়হরণ, ঝিনুক পিঠা, তালের কেক, তালের ফুলঝড়ি, পাখির বাসা, তালের মাংস সিংড়াসহ বিচিত্র সব পিঠা। প্রতিটি পিঠার দাম ছিল ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত।
প্রতিটি স্টলে প্রায় ২০ থেকে ৩০ রকমের পিঠা দেখা যায়। বাড়ি থেকে তৈরি করে আনা পিঠার পাশাপাশি অনেক স্টলে বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরিও করা হয়।
পরিবার নিয়ে নওগাঁর সদর থেকে পিঠা উৎসব দেখতে আসেন গোলাম রাব্বানী । তিনি বলেন, সারি সারি তালগাছের সড়কে আসলে এমনিতেই হৃদয়ে একটা প্রশান্তি অনুভব হয়। প্রায় প্রতি শুক্রবার পরিবার নিয়ে আমি এখানে আসি। আজকে আরও ভালো অনুভূতি হচ্ছে। এখানে একসঙ্গে অনেক রকমের পিঠা পাওয়া যাচ্ছে। আমার সাত বছর বয়সী মেয়ে অনেক পিঠাই আগে চিনতো না। এখানে এসে অনেক ধরণের পিঠা দেখে ও তার স্বাদ নিতে পেরে সে অনেক খুশি। তাছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকায় আরও ভালো লাগছে।
বিকেলে পিঠা উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্যে রাখেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, হাজিনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আশির দশকে হাজিনগর-ঘুঘুডাঙা দুই কিলোমিটার সড়ক জুড়ে এই তালগাছগুলি আমি লাগিয়েছিলাম। আজকে সেই সব তালগাছ বড় হয়ে সড়কটিকে সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। মানুষজন এই সড়ক দিয়ে যখন যায়, তালগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু প্রশান্তি পায়। আমি নিজেও এলাকায় আসলে তালগাছগুলি দেখতে আসি। একটা অন্য রকম প্রাশান্তি অনুভূত হয়।
মন্ত্রী আরও বলেন, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে পিঠা পুলির আয়োজন। আর এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেই প্রতি বছরের মতো এবারো শুরু হয়েছে নিয়ামতপুরের হাজিনগর ইউনিয়নের তালতলিতে তাল পিঠা মেলা। সড়কটি পর্যটকদের কাছে পরিচিত করতে উপজেলা পরিষদ তাল পিঠা উৎসবের যে আয়োজন করেছে এটা একটি ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে মানুষ একটা নির্মল বিনোদন পাচ্ছে। পাশাপাশি গ্রাম বাংলার হারিয়ে যেতে বসা অনেক ধরণের পিঠার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে এ প্রজন্ম।
নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক সুফিয়ান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান, গণমাধ্যম শাইখ সিরাজ, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক, নিয়ামতপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ প্রমুখ।
উৎসবের আয়োজক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ বলেন, এবারের উৎসবে যে পরিমান মানুষের সাড়া পেয়েছি তাতে আমরা অভিভূত । অনেক দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হরেক রকমের পিঠার সমাহার নিয়ে এখানে স্টল দিয়েছে। ঘুঘুডাঙার তাল সড়কে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে তাল সড়কের পাশে খাস জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের সুবিধার্তে গণসৌচাগার নির্মান করা হয়েছে। আগামীতেও এখানে পিঠা উৎসবের আয়োজনের ইচ্ছে রয়েছে বলেও জানান তিনি।