বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনীতির মাঠ কিছুদিন ধরে বেশ উত্তপ্ত ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে দেশের প্রধান এই দুই দলের মধ্যে নির্বাচনের সময়সূচি এবং আরও কিছু নীতিগত বিষয়ে বেশ মতভিন্নতা চলছিল। এ নিয়ে দুই দলের নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন। এতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে বলে মনে করেছিলেন অনেকেই। তবে শেখ হাসিনা-পরবর্তী দেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কিছু ইস্যুতে দূরে দূরে থাকলেও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে হঠাৎ করেই কাছাকাছি আসছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে কয়েকবার বলেছেন, দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার চাইলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে আর ছোট আকারের সংস্কার চাইলে সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে। এছাড়া ঈদুল ফিতর উপলক্ষে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন আয়োজনে বিরোধী বিএনপি। চলতি বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায় তারা। বিএনপির এই দাবির পক্ষে রয়েছে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। আর জামায়াতের দাবি ছিল, সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী নেতারা জানান, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তারপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন চায় তারা। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অবশেষে জামায়াতে ইসলামীর দাবি কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখন নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে দলটি।
অন্যদিকে, জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠা নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবি, আগে সংস্কার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সবশেষে জাতীয় নির্বাচন। আবার গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিও তুলছে এনসিপি।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া এনসিপি নির্বাচনে যাবে না। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় রাখার কথাও শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে চলছে নানা আলোচনা।
আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচনের লক্ষ্য ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। প্রাক-প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো গুছিয়ে জুন-জুলাইয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হবে। আর আগামী অক্টোবরের আগেই রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে ইসি মতবিনিময় করবে। দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় আগস্ট-সেপ্টেম্বর বা সম্ভব হলে তার আগে করা হবে।
এদিকে, নিজেদের অবস্থান মোতাবেক ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবিতে বুধবার আবারও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। দীর্ঘ পৌনে দুই ঘণ্টার বৈঠকে নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা না পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিএনপি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠক শেষে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো জানিয়েছি তাকে। যার মধ্যে প্রধান ছিল নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ।
আমরা বলেছি, বর্তমানে রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি আছে এবং দেশের যে অবস্থা, তাতে আমরা বিশ্বাস করি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে বৈঠকের পর আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, ডিসেম্বর মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
এদিকে আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন চায় জামায়াতে ইসলামী। কেননা, ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত আগামী নির্বাচনের জন্যে অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাই আগামী বছরের প্রথম রমজানের আগেই নির্বাচনের পক্ষে জামায়াত।
এদিকে আমির ডা. শফিকুর রহমান লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ওই সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি দেশে এসে গতকাল বুধবার ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, নির্বাচন রমজানের আগেই শেষ করতে হবে। জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড়ঝাপটা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন আবার ইলেকশনটা (নির্বাচন) অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সে জন্য আমরা চাইছি, ওই আশঙ্কার আগেই যেন নির্বাচন হয়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পরে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের যে অবস্থান ছিল সেটি বিএনপির সঙ্গে মেলে না। এখন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান আগামী বছরের রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন হওয়া দরকার মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি এক ধরনের পরিবর্তন। এই পরিবর্তন হয়তো লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের আমিরের বৈঠকের ফল হতে পারে।
নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের কাছাকাছি অবস্থান প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসারই কথা। কারণ সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হলো ক্ষমতায় যাওয়া। আর ক্ষমতায় যাওয়ার নিয়মতান্ত্রিক পথ হলো নির্বাচন।
তিনি আরও বলেন, জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের পেছনে অবশ্যই লন্ডনের প্রভাব আছে। বিএনপি চেষ্টা করছে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে যাতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ করা যায়। বিএনপির এই নির্বাচনের দাবিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তবে আমি যতটুকু বুঝতি পারছি, বিএনপি দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে নির্বাচন চায়।
তিনি যোগ করেন, জবাবদিহিমূলক শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এমনই হওয়া উচিত। জবাবদিহিমূলক শাসন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্যে সবার রাজনীতি করা উচিত। অন্যথায় খুব সহজেই তৃতীয় পক্ষ সুবিধা নিয়ে নিতে পারে।