ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, প্রচলিত ভূমি জরিপে যেখানে ২০-২৫ বছর লাগে, সেখানে খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ করা সম্ভব হবে। এই জরিপ শুরুর সাথে সাথে খসড়া ম্যাপ তৈরি করে ওয়েবসাইটে দেয়া হবে যাতে জমির মালিক পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে তার জমির ম্যাপ দেখে জমির পরিমাণ কমবেশি হলে সাথে সাথে আপত্তি দাখিল করতে পারেন। ডিজিটাল জরিপে যাবতীয় তথ্য ডিজিটাল ও নির্ভুল হওয়ায়, জরিপে স্বচ্ছতা আসবে, মামলা মোকদ্দমা কমে আসবে, সাথে জনগণের ভোগান্তিও কমে আসবে।
আজ বুধবার পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন মাঠে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে – বিডিএস)-এর পাইলটিং-এর উদ্বোধন করার পর বক্তব্য প্রদান করার সময় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এই কথা বলেন। এই সময় ভূমি সচিব মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান পিএএ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সর্বাধুনিক ফোর্থ জেনারেশন সার্ভে ড্রোনের মাধ্যমে ডিজিটাল জরিপের পাইলটিং পটুয়াখালী থেকে শুরু হচ্ছে। পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় এসএ জরিপের পর আরএস জরিপ সম্পন্ন না হওয়ায় উক্ত দুটি জেলার ১৪ টি উপজেলা বিডিএস এর জন্য বাছাই করা হয়েছে। পটুয়াখালীর সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া ইউনিয়ন থেকে শুরু হবে এই জরিপ।
অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলমগীর, সাধারণ সম্পাদক বীর মক্তিযোদ্ধা ভিপি আবদুল মান্নান এবং সংরক্ষিত নারী আসন-২৯ থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেন।
বরিশালের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো: ওয়াহেদুর রহমান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ কুমার দাস, বিডিএস কার্যক্রমের প্রকল্প পরিচালক মোঃ আব্দুল মান্নান, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক এ টি এম নাসির মিয়া এবং পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন, পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ ভূমি মন্ত্রণালয় ও পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, স্থানীয় সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার এবং ১৫ আগস্টের অন্যান্য সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে ভূমিমন্ত্রী তাঁর বক্তব্য শুরু করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে জরিপকাজে দীর্ঘসূত্রিতা ও জনগণের হয়রানি কমানোর জন্য ডিজিটাল জরিপ করার নির্দেশ প্রদান করেন। তারই প্রেক্ষিতে আমাদের এই উদ্যোগ।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, আমাদের অন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্যাটেলাইট ইমেজ কিনে সেটা মৌজা ম্যাপের সাথে সমন্বয় করে ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে, এর ফলে কৃষিজমি, জলাভূমি, পাহাড় ও বনভূমি রক্ষাসহ জমির পরিকল্পিত ব্যবহার করাও সম্ভব হবে।
এনআইডি ইন্টিগ্রেশন থাকায় এখানে জমির মালিকানা, শ্রেণি ও ধরন ইত্যাদি বিষয়ে ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠবে, যা দিয়ে উপজেলা, জেলা, বিভাগভিত্তিক ও জাতীয় তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠবে, ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, বিডিএস একবার ঠিকভাবে করা সম্ভব হলে পুনরায় মাঠ জরিপ করার প্রয়োজন হবে না কারণ জমি হস্তান্তর হলে এসিল্যান্ড প্রয়োজনীয় ডাটা ইনপুট দিয়ে নিজেই ম্যাপ পার্টিশন করে নিতে পারবেন। ম্যাপে সুনির্দিষ্ট দাগে ক্লিক করে ঐ দাগের জমির মালিকানা, জমির পরিমাণ, চৌহদ্দি ও শ্রেণিসহ অন্যান্য তথ্য পাওয়া যাবে।
বিডিএস পাইলটিং-এর ম্যাপ তৈরি করার জন্য এবার পরীক্ষামূলকভাবে এবার প্রথমবারের মত ডিজিটাল ভূমি জরিপ কাজে সক্ষম বেসরকারি প্রতিষ্ঠাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ভূমিমন্ত্রী বলেন, তবে জরিপের খতিয়ান প্রস্তুত এবং মালিকানা নির্ণয়ের পর্যায়ের কাজ সরকারিভাবেই করা হবে। এই পাইলটিং এর অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তীতে দেশের বাকী জেলায় একযোগে শুরু করার পরিকল্পনা করা বিডিএস-এর শুভ উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন ভূমিমন্ত্রী।
ভূমি সচিব মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান পিএএ জানান, বিডিএস ম্যাপে জমির পরিমাণ, জমির আইলের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আকার ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যাবে। এই জরিপে তৈরি ম্যাপটিতে সেন্টিমিটার পর্যায় পর্যন্ত এই ভূমি পরিমাপের নির্ভুলতা থাকবে। ডিজিটাল জরিপ বিষয়ে ১৯৫৫ সনের প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ৩০ বিধিতে আপত্তি ও ৩১ বিধিতে অনলাইনে আপীল আবেদন ও শুনানি নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সচিব জানান, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার জমি, খাস জমি, রাস্তাঘাট, জলাধার, নদী খাল ইত্যাদি চিহ্নিত করা হবে, ফলে জমি দলিল ও নামজারি করার সময় জালিয়াতি করে সরকারি জমি আত্মসাৎ বন্ধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে দাগভিত্তিক প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ জেনে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ ও প্রদান ও জালিয়াতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে এই জরিপ শেষ হলে।
প্রসঙ্গত, সারাদেশে ডিজিটাল জরিপকরণের সক্ষমতা অর্জনের জন্য সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ভূমি মন্ত্রণালয় ১২১২.৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প’ নামে ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে, নির্ভুলভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য বাংলাদেশ ভূমি জরিপ তথা বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভেতে স্যাটেলাইট, ড্রোন তথা ইউএভি এবং গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের সমন্বয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
এজন্য তিনটি পার্বত্য জেলা ব্যতীত সারাদেশের ৪৭০টি উপজেলার মৌজা পর্যায়ে জিওডেটিক সার্ভের মাধ্যমে ২,৬০,৩১০টি জিও-রেফারেন্সিং পয়েন্ট নির্ধারণ করা হবে ও ১,৩৩,১৮৮টি মৌজা ম্যাপের ডাটাবেজ ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হবে। ভূমিতে পূর্বে জরিপ করা থাকলে উক্ত জরিপের ডিজিটাইজ ম্যাপের সাথে নতুন প্রস্তুত ম্যাপের সুপার ইম্পোজের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে নতুন জিও রেফারেন্স মৌজা ম্যাপ। এছাড়া পরবর্তীতে, ‘মৌজা ও প্লট ভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্প’-থেকে সংগ্রহ করা স্যাটেলাইট ইমেজের সাথেও সমলয় করা হবে এই মৌজা ম্যাপ।
বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের মূল উদ্দেশ্য অল্প সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে তথা ভূ-সম্পদ জরিপ শেষ করা এবং পরবর্তীতে মাঠে গিয়ে সার্ভের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে নিয়ে আসা। এছাড়া কোনো এলাকায় প্রাকৃতিক কারণে বড় ধরণের ভূমির বিচ্যুতি না ঘটলে রিভিশন্যাল সার্ভের প্রয়োজনীয়তাও থাকবেনা ডিজিটাল ম্যাপ পার্টিশনের সুবিধার জন্য। এ প্রকল্পের আওতায় নির্ধারিত জিও-রেফারেন্স-কৃত মৌজা ম্যাপ ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ প্রকল্পে সরবরাহ করা হবে। জমি বিক্রির পর নামজারি খতিয়ান পরিবর্তনের সাথে সাথে ম্যাপের সীমানা পরিবর্তন হয়ে যাবে।
পরিমাপের ক্ষেত্রে ইমেজ থেকে সুবিধা-মতো রেফারেন্স এর কো-অর্ডিনেটের মান ও মৌজা ম্যাপের যে কোন প্লটের দূরত্বের মাপ ও প্লটের খতিয়ান নির্ধারিত দৈর্ঘ্যপ্রস্থ মাপ ও চার কোনার চারটি কো-অর্ডিনেট মান নিয়ে কনভেনশনাল ও আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমির যে কোন প্লটের পরিমাপ, ল্যান্ড ডিমার্কেশন, ল্যান্ড ডিভাইডেড করা সম্ভব হবে । দরকার হবে না আলাদা ভাবে স্থাপিত কোন রেফারেন্স জিওডেটিক পিলার তথা জরিপের জন্য পিলার স্থাপনের।