সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে যে প্রতিবেদনের কারণে তাঁকে আজ বুধবার ভোর চারটায় বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই প্রতিবেদন ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
আজ দুপুরে সচিবালয়ে আয়োজিত সমসাময়িক ইস্যুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, নবীনগরে একটা বাচ্চার হাতে ১০ টাকা দিয়ে স্বাধীনতা নিয়ে তার মন্তব্য নেওয়া হয়েছে। ছেলের নাম সবুজ। তাকে বানানো হয়েছে জাকির হোসেন। ছেলে স্কুলের ছাত্র, তাকে বানানো হয়েছে দিনমজুর। এটি কোন সাংবাদিকতা, এই প্রশ্ন তোলেন ওবায়দুল কাদের।
উল্লেখ্য, গত রোববার প্রথম আলো অনলাইনের এক প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ভুল করে ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতিটি নজরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর। বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।
প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক ছিলেন শামসুজ্জামান। তাঁকে আজ ভোররাতে তাঁর বাসা থেকে সিআইডির পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।
সচিবালয়ে সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মতবিনিময় শুরু হয় বেলা সাড়ে ১১টার পরপর। এতে মন্ত্রীর বক্তব্যের পর একজন সাংবাদিক তাঁকে জানান, যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল, সেটি সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদককে ভোররাতে সিআইডি পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকের কথার পিঠেই ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সেটি আমি জানি না। কিন্তু কথা হলো রিপোর্টটা কী রিপোর্ট।’ উত্তরে ওই সাংবাদিক বলেন, পরে সেটি সংশোধন করা হয়েছে। উত্তর শুনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কিসের সংশোধন। এত বড় মিথ্যাবাদ, মিথ্যা রিপোর্ট করা, সরি বললেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়?…এটা একটা অপরাধ।’
ওবায়দুল কাদেরের কাছে সাংবাদিক জানতে চান, প্রথম আলোর প্রতিবেদনটির মূল বিষয়বস্তু ছিল বাজারে নিত্যপণ্যের দাম। বাজারে জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম এখন কমছে। আস্তে আস্তে আরও কমবে। জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি সারা দুনিয়ায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা দুনিয়াতেই দাম বাড়ছে।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্বই সংকটে আছে বলে উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘সারা বিশ্বেই কস্ট অব লিভিং (জীবনযাত্রার ব্যয়) লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, এটা তো বলা যাবে না। আমরা বেশি দামে কিনি, অল্প দামে বিক্রি করতে হয়, এটিই তো বাস্তবতা।’
এবার সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, প্রথম আলো যে ভুল করেছে, কিংবা যদি অন্যায় বলা হয়, সেটি প্রেস কাউন্সিল আইনের মাধ্যমে বিহিত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সাংবাদিককে ভোরে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসা কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে?
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’ তখন আরেক সাংবাদিক বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, আপনাকে কনফার্ম (নিশ্চিত) করছি তুলে নেওয়া হয়েছে। আপনি কী মন্তব্য করবেন?’ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি আপনার থেকে শুনে কেন বিশ্বাস করব। আমাকে জানতে হবে।’
এরপর গণমাধ্যমকর্মীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, পত্রিকা ভুল প্রকাশ করল। সংশোধন করল। সাংবাদিক হিসেবে যা যা করার তারা করছে। কিন্তু তাতে প্রসঙ্গটা কি মিথ্যা হয়ে গেল? মানুষের যে কষ্ট…। উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সেটা আমিই তো বললাম, কস্ট অব লিভিংয়ের কারণে সারা দুনিয়াতে কষ্টটা আছে। কষ্ট শুধু বাংলাদেশের না। বাংলাদেশেও কষ্ট আছে। বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম কমেছে। আরও কমবে।’
সরকার আন্তরিকভাবে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে বলেও দাবি করেন ওবায়দুল কাদের। সঙ্গে সঙ্গেই একজন গণমাধ্যমকর্মী মন্তব্য করেন, এ ব্যাপারে (জিনিসপত্রের দাম কমানো) যত না আন্তরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘স্পিডি’ (তৎপর) একজনকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে। মন্তব্য শুনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘একটি ফলস নিউজ দিল একটা বাচ্চার নামে, সেটাকে আপনাদের একটু রিঅ্যাক্ট করতে দেখি না, আপনি রিঅ্যাক্ট করছেন কারে উঠায়ে নিয়েছে, সেটা তো আমি জানি না। সেটা আমি এখনো জানি না।’
প্রেস কাউন্সিল আইনে এর বিহিত করার সুযোগ আছে—আবারও এক সাংবাদিক উল্লেখ করলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি জানি না যেটা, সেটার জবাব কীভাবে দেব? আর আপনি একটা বাচ্চার নামে রং নিজউ দিবেন, রং না ইচ্ছে করে, পলিটিক্যালি মোটিভেটেড নিজউ দিলেন, এটার জবাব কী।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যাপারেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, একটা মন্ত্রণালয়ের যতগুলো মেগা প্রজেক্ট এ পর্যন্ত উদ্বোধন করা হয়েছে, এ সরকারের আমলে যতগুলো মেগা প্রজেক্ট হচ্ছে, অনেকগুলোর কাজ প্রায় শেষ। এত সাফল্যকে শুধু দুর্ঘটনা দিয়ে ম্লান করে দেওয়া যাবে না।
উল্লেখ, ২২ মার্চ প্রথম আলোতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো নিয়ে ‘সড়ক মন্ত্রণালয় পারছে না’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অবশ্য আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় ওবায়দুল কাদের এই প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেননি।