সালাম মাহমুদ: বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান, দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, সামাজিক সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠান নিয়ে কাজ করি, রাজনীতি করি, সাংবাদিকতাই আমার একমাত্র পেশা। সেই সুবাদে বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছিলাম বাংলাদেশের বহুল পরিচিত, বাচসাস পুরস্কারসহ অনেকগুলো পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞাপনচিত্র ও নাট্যনির্মাতা শহীদ রায়হান একটি চলচ্চিত্র নির্মান করছেন।
চলচ্চিত্রটির নাম ‘মনোলোক’। সাংবাদিক মহল থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক মহলে ‘মনোলোক’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে বেশ গুঞ্জন। আমার কাছের কয়েকজন সাংবাদিকসহ এক চায়ের আড্ডায় দেশের চলচ্চিত্র ধারা নিয়ে আলোচনায় হঠাৎ করে ‘মনোলোক’ চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। সেই আলোচনার সুত্র ধরে সত্যজিৎ রায়- ঋত্বিক ঘটক- মৃণাল সেন এর মত কালজয়ী নির্মাতার নির্মিত বাংলা রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, প্রতিবাদী চলচ্চিত্র পর্যন্ত ঠেকলো। ভেতরে ভেতরে আমার কৌতুহল তখন তুঙ্গে। এমন কি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন নির্মাতা শহীদ রায়হান! চলচ্চিত্রটি এখনো মুক্তি পায়নি- তবুও কেনো মনোলোক নিয়ে এতো জ্ঞানগর্ভ আলোচনা- বিতর্ক। মনে মনে ঠিক করলাম নির্মাতার মূখোমুখি হবো। স্বভাব সুলভ আচরণে হাসিমুখে দরজার কাছে এসে স্বাগত জানালেন। অনেক দিন দেখা হয়না তাই নানান গল্পের ফাঁকে বললেন কি খাবেন- চা কফি? আমি বললাম না- মনোলোক খাবো। ভেবেছিলাম অট্টহাসি বেরিয়ে আসবে, কিন্তু না- উল্টো গম্ভির আর উদাস হয়ে পড়লেন শহীদ রায়হান। তার রুমের দেয়ালে ঝুলানো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একটি বিরল ছবির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন যদি মনোলোক মুক্তি পায় হলে বসে এক সাথে মনোলোক খাবো। দুই ঘন্টা দশ মিনিটের মনোলোক এখানে বসে দেখার ধৈর্য আপনার থাকবেনা ভাই। আমি আমার মোবাইল ফোনটি অফ করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম প্লিজ শহীদ ভাই আজ এটাই আমার কাজ। তিনি ক¤িপউটারের মনিটরটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে মনোলোক চলচ্চিত্রটি প্লে করে দিলেন।
প্রথম দৃশ্যে চারবার জাতিয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু আর দীপা খন্দকার। কি অসাধারণ বিষয় আর দৃশ্যায়ন। পশুরাও যে প্রতিশোধ নিতে কুন্ঠিত হয়না- বিশেষ করে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তা দেখে মানুষ হিসাবে নিজের প্রতি অনেক ধিক্কার জেগে উঠলো মনের মধ্যে।
সুবিশাল এক স্টাডি রুম। দেশ এবং রাজনীতি পরিচালনার গবেষণাগার। পবিত্র কোরআন পাঠ করছেন জাতিয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী নিপুণ। দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রæ। এখান থেকেই যে মনোলোক এর শুরু তা বুঝে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেলো। নিপুণ এর চরিত্র একজন রাজনৈতিক নেত্রীর, সময় এবং প্রেক্ষিত অনুসারে অনুমান করে নেয়া যায় যে এই চরিত্রটি বাংলাদেশের ‘মা’ রূপক অথবা সাজগোজে কেউ কেউ ভাবতে পারেন এই চরিত্রটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁর ভাবনা থেকে একে একে আসেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গঠিত প্রবাসী সরকারে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন সাহেব। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ভ‚মিকা আর তার দর্শন নিয়ে হাজির হন গোলম আজম। প্রত্যেকটি চরিত্র অবলীলায় তাদের অচেতন মনে লুকিয়ে থাকা রাজনৈতিক প্রবাহের দার্শনিক তত্ত¡ কাল্পনিক বিশ্লেষণে উপস্থাপিত হয়েছে। অপূর্ব কাঠামোতে গড়ে উঠেছে প্রতিটি চরিত্রের স্বরূপ যা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বা সাধারন মানুষকে নৈতিক বা আদর্শিক রাজনৈতিক তথ্য উপাত্তে সমৃদ্ধ করবে।
দেশ মাত্রীকার ‘মা’ স্বরূপ নিপুণের চিন্তায় ভর করে ছোট্ট শিশু রাসেল। হিমালয় সম কষ্ট আর বেদনার পাহাড় ভর করে আমার হৃদয়ে। আসে খুনি মোস্তাক। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে তার স¤পৃক্ততার ৩৪ বছরের ইতিহাস আর তাকে যারা আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত শক্তি যুগিয়ে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছেন তাদের বৃত্তান্ত উন্মুক্ত করেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে, তৎকালিন ঘটনা প্রবাহের নিরিখে। আমার মনে হয়েছে একজন সত্যিকারের রাজনৈতিক কর্মী বা বাংলাদেশের একজন সচেতন সাধারণ জনগণ হিসাবে এই ইতিহাস, এই তথ্য, এই ঘটনা প্রবাহ সবার কাছে পৌছে দেওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিলো, দেশের সকল রানীতি বিদদের দায়িত্ব ছিলো। আমরা যদি আমাদের দায়িত্বটা সচেতনভাবে পালন করতাম তাহলে আমাদের দেশে বা বাঙালী জাতীতে এমন বিভাজন তৈরী হতো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এমন উক্তি করতে হতো না।
১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের প্রতিক হিসাবে চিহ্নিত চিলমারীর বাসন্তীর জ্বাল পরার কাহিনী যে পরানোর কাহিনী তা দেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষ জানেন না। তারা যা যানেন তা নির্মম, বিকৃত। দেশের রাজনীতির মাঠে- ভোটের রাজনীতিতে বাসন্তীর গল্প প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে সবসময়ে বিব্রততে ফেলে দেয়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্নকে মটিভেটেড করতে এই গল্প মাদকের মত কাজ করে। বাংলাদেশ বিরোধী শক্তির রচিত এসব কল্পকাহিনী থেকে জনসাধারন তথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক কর্মীদের বের করে আনতে বাসন্তী পর্বের উপস্থাপনা যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখবে বলে আমার মনে হয়েছে।
মনোলোক চলচ্চিত্রের শেষাংশ ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার নারকিয়তা আবর্তিত। ২১শে আগষ্ট আওয়ামী লীগের কর্মীদের জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা পেয়েছে কিন্তু ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সালে এই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের কর্মীরা কেন নির্জীব ছিলেন তার আত্ম সমালোচনা এবং স্বাধীন সার্বভৌম মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখতে বাংলাদেশের মানুষের তথা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং চেতনা কি হওয়া উচিৎ, কোন রাজনৈতিক আদর্শ, সংগঠন, কোন নেতৃত্ব বাংলাদেশকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখতে পারে তার একটি শৈল্পিক ইঙ্গিত রেখে নির্মাতা শহীদ রায়হান চলচ্চিত্রটি শেষ করেছেন।
চলচ্চিত্রটির আনুসাঙ্গিকতা, ত্রটি, বিচ্যুতি যা কিছু আমার চোখে পড়েছে তা হারিয়ে গিয়েছে একটি প্রশ্নের কাছে- আর তা হলো চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কেনো আপনি থিয়েট্রিক্যাল ফরম বেছে নিলেন? নির্মাতার সাবলিল উত্তর মনোলোক আমার কল্পনার স্বরূপ। চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে একজন নির্মাতা প্রচলিত ফর্মই বেছে নিবেন বা নিতে হবে এমনতো কথা নেই। চলচ্চিত্র নির্মাণে কোনো সংবিধিবদ্ধ কাঠামো নেই। নির্মাতা স্বাধীন। আমি নির্মাতার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। দর্শক সেটি গ্রহণ করতেও পারে আবার নাও করতে পারে। আমার শেষ প্রশ্ন- মনোলোক চলচ্চিত্র দিয়ে আপনি কি এ্যাচিভ করতে চান- মানে আপনার লক্ষ্য কি? নির্মাতার উত্তর- আমি স্বপ্ন দেখি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ। নির্মাতা জানালেন মনোলোক চলচ্চিত্রটি ৫ ফেব্রæয়ারী ২০২৩ সেন্সরের জন্য সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছেন কিন্তু অদ্যাবদি চলচ্চিত্রটি সেন্সর বোর্ডের প্রদর্শন তালিকায় স্থান পায়নি। নির্মাতার চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত মত, পথ, প্রকৃয়া এবং উদ্দেশ্যের সাথে আমার ব্যক্তিগত অমিল রয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তবুও বলবো মনোলোক চলচ্চিত্রটি আমার দেখা বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক চলচ্চিত্র এক কথায় বলতে গেলে মনোলোক হচ্ছে বাংলাদেশের জন্মের, টিকে থাকার ‘হিষ্টোরিক্যাল এপিক’।
মনোলোক চলচ্চিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাদের অভিনয় পারঙ্গমতা দেখাতে একটুও কার্পণ্য করেননি। সেট, শিল্প নির্দেশনা, লাইট, মেক-আপ, গেটাপ, আবহসঙ্গীত সব কিছুই সময় উপযোগী। ফজলুর রহমান বাবু, নিপুণসহ এই চলচ্চিত্রে আরো অভিনয় করেছেন- দীপা খন্দকার, এম এ বারী, আশরাফুল আশিষ, নেয়াজ মোহম্মদ তারেক, সঙ্গীতা চৌধরী, এ কে আজাদ সেতু, মাসুদ মহিউদ্দিন, সুমু চৌধুরী। মিউজিক ডিরেক্টর- রিপন খান, শিল্প নির্দেশক- রহমতউল্লাহ বাসু, চিত্রগ্রহন- সাহিল রনি, কষ্টিউম- প্রিথীমনি, মেক-আপ- মোহাম্মদ আলী বাবুল।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট,
সভাপতি, টেলিভিশন রিপোর্টার্স ইউনিটি অব বাংলাদেশ(ট্রাব)