সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। জাতি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পরই ১৯৭২ সালের সংবিধানে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেন তিনি।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার মানন্নোয়ন ঘটে। প্রণীত হয় জনকল্যাণমুখী শিক্ষানীতি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্বাক্ষরতার হার সে সময় ৪৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ শতাংশে ।
বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সুযোগ তৈরি করেন। আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন-১৯৫৭ (নং ১০৭)-এর ২২৩ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় এ সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠদানের সনদ দেয়া হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে ২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং তা সর্বসম্মতভাবে সংসদে শিক্ষানীতি-২০১০ অনুমোদিত ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ প্রণয়ন করা হয়।
ঝরেপড়া এবং স্কুলে না আসা শিশুদের লেখা-পড়ায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য ২০১০ সালে স্কুল, মাদ্রাসা, টেকনিক্যাল- সকল ধরণের ছাত্র- ছাত্রীদের জন্য (প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত) বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
আদিবাসী শিশুরা যখন নতুন ভর্তি হয় তখন তারা যে ভাষা, অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে তা তাদের পরিবার ও সমাজের প্রচলিত ভাষা, যা তার পাঠ্য বইয়ের ভাষা বা পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ভাষা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার কারণে আদিবাসী শিশুরা পাঠের বিষয়বস্তু’র সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং যে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করার কথা তা করতে পারে না। ফলে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবার পর আরো বেশী অসহায় হয়ে পড়ে। বলা যায়, একই পাঠ্যক্রমের অধীনে একই সময়ে, একই পাঠদান পদ্ধতিতে আদিবাসী শিশুদের বাংলা ভাষাভাষী শিশুদের মত একই যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব নয়। আদিবাসী ও বাংলাভাষী শিশুদের দক্ষতা ও পাঠের বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ভিন্ন ও অসম এবং এই ভাষাগত দুর্বলতার কারণে আদিবাসী শিশুরা অনেক বিষয় সমভাবে অর্জন করতে সক্ষম না হয়ে পর্যায়ক্রমে পিছিয়ে পড়তে পড়তে এক সময় প্রাথমিক স্তরেই ঝরেপড়ে। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শুধু প্রথম শ্রেণি থেকে শতকরা অন্তত ৩০ জন শিশু স্কুল ত্যাগ করছে আর মাতৃভাষা বিবর্জিত শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে আদিবাসী শিশুদের অবস্থা আরো বেশী শোচনীয়। ফলে একটি জরীপে দেখা যায় আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ঝওে পড়ার হার এলাকাভেদে ৬০% থেকে ৭০% হয়ে থাকে। এজন্য ২০১০ সালের শিক্ষানীতি; আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করাকে সরকার প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে নেয়।
২০১২ সালে শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রথম দফায় ৫ টি মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৫টি ভাষায় (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদবি এবং গারো) প্রায় ১৫ লাখ বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করেছে সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী সংরক্ষিত আরও ১৩টি ভাষার বই প্রস্তুতের কাজ চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৩৭ টি হলেও এদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক ভাষার বর্ণমালা আছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় বই বিতরণের উদ্যোগ তাই সকল ক্ষেত্রে প্রশংসনীয়। এ ভাষা সংরক্ষণ সমগ্র দেশ ও জাতির জন্য সম্মান ও গৌরবের।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে শিক্ষা ও ভাষা অনুরাগী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী ও ট্রাইবাল) জনগোষ্ঠীর সংরক্ষিত সকল ভাষার বই বিতরণের মহৎ কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার আশা করছে।
–প্রফেসর ড. মো. নাছিম আখতার, উপাচার্য- চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর।