পূর্ব পেনসিলভেনিয়ার ছোট্ট একটি শহর। নাম ‘জিম থর্প’। পাহাড়, স্থাপত্য আর প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যাবলীর জন্যে এই শহরটিকে একদা ‘আমেরিকার সুইজারল্যান্ড’ বলা হতো। নেটিভ আমেরিকান ক্রীড়াবিদ জেমস ফ্রান্সিস থর্পের নামে শহরটির নামকরণ করা হয়। যদিও জিম থর্প এই শহরে জন্মগ্রহণ করেননি, বেড়ে উঠেননি কিংবা তাঁকে এখানে সমাহিত করা হয়নি। তাঁর নামে শহরটির নামকরণ করা হয়েছে, কারণ তিনি ছিলেন প্রথম নেটিভ আমেরিকান ক্রীড়াবিদ যিনি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। ১৯১২ সালে অর্জন করা সম্মানজনক এই পদক পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১৩ সালে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়। ১৯০৯ এবং ১৯১০ সালে কিছু নিয়ম লঙ্ঘনই ছিল এর কারণ। জিমের মৃত্যুর ৩০ বছর পর সমর্থকদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা আর আইনি পদক্ষেপের হুমকির ফলে ১৯৮৩ সালে কর্তৃপক্ষ পদকটি ফিরিয়ে দেয় তাঁর পরিবারকে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে জিম থর্পকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
আমরা যখন ‘জিম থর্প’ শহরে পা রাখি, আমার ভেতরের বহুদিনের ঘুমন্ত খেলোয়াড়সুলভ মনটি জেগে উঠেছিল যেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুর্দান্ত সেই সময়গুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আমার শহরের ইন্টারস্কুল হ্যান্ডবল, ভলিবল, ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করেছি বহুবার। দেশ ছেড়ে আসার পর শোকেস ভর্তি আমার সকল অর্জন, পুরস্কার দেখে দেখে অশ্রুজল বিসর্জন দিতেন আমার মমতাময়ী মা। শহরটিতে পা রাখার মুহূর্তে আমার মনে হয়েছে, আমি যে শহরে দাঁড়িয়ে আছি, এটি প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণপদক বিজয়ী একজন খেলোয়াড়কে সম্মান জানিয়ে তাঁর নামে নামকরণ করা শহর! যে শহরে আছে ছোট ছোট দোকান, রেস্তোরাঁ, মিউজিয়াম এবং লেহাই জর্জ সিনিক রেলপথ (lehigh Gorge Scenic Railway)।
আমরা পরিবার ও বন্ধুদের বিশাল বহর নিয়ে শনিবার বিকেলের শেষ ট্রেনটি ধরার উদ্দেশ্যে টিকেট কাটলাম। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আর ট্রেনের খোলা জানালায় বাতাসের বিপরীতে মুখ বাড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা, এ যে আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে প্রথম! চারটা বেজে তিরিশে ট্রেনটি ছেড়ে যায়। আমরা মুগ্ধ হয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। ট্রেন হিশ হিশ শব্দে ছুটে চলছিল ওভার ব্রিজের উপর দিয়ে। নিচে স্রোতস্বিনী নদীর ফেনায়িত জল। লেহাই নদী। কখনো ঘন জঙ্গলে কিংবা পাথরের প্রাচীরের ভেতর ঢুকে পড়ছিল ট্রেনটি। জল গড়িয়ে পড়া পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে যেতে যেতে মনে হয়েছে নিঃসঙ্গ পাহাড় কোনো অব্যক্ত বেদনায় শতাব্দীর পর শতাব্দী কেঁদে চলেছে অবিরত। দূরে, বহুদূরে দাঁড়িয়ে ছিল ঘন সবুজ ‘পোকোনো মাউন্টেইন’। যাত্রীদের কেউ একজন বলছিল, শরত-হেমন্ত এই স্থান ভ্রমণের জন্যে সঠিক সময়। সেই সময় গাছের পাতা বর্ণিল রূপ ধারণ করে। তখন চারপাশটা অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। ট্রেনটি লেহাই জর্জ স্টেট পার্ক পর্যন্ত গিয়ে থামে। স্বল্প বিরতিতে আবার উল্টোপথে ছুটে চলে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করছিল। আমরা এতক্ষণ বাঁদিকের দৃশ্য দেখছিলাম। ফিরতি পথে জায়গা বদল করে ডানদিকের জানালার পাশে বসি। কখনো ঝোঁপের আড়ালে, কখনো নদীর উপর দিয়ে চলছি তো চলছি। আচমকা দূর থেকে ভেসে আসে জলের কলকল শব্দ। যতই নিকটে আসি, শব্দটি আরও প্রকট হয়ে উঠে। বাইরে তাকাতেই নজরে এলো ঝর্ণা। প্রাচীন পাহাড়ের কোল ঘেঁসে প্রাকৃতিক ঝর্ণা। প্রবল বাতাস বইছিল। বাইরে হাত বাড়িয়ে বাতাস ধরার চেষ্টা করি। মুখ বাড়িয়ে খাড়া দেয়াল, লেহাই নদী, জলপ্রপাত, ঘন গাছেপালা দেখি। খুব ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে দাদার বাড়ি যাবার সময় আমি এমন করে ট্রেনের জানালায় মুখ বাড়িয়ে ধানক্ষেত, সর্ষেক্ষেত দেখতাম। ছোট ছোট হাত বাড়িয়ে এমনি করে বাতাস ধরতে চাইতাম। প্রকৃতির অদ্ভুত এই সৌন্দর্য দেখে আনন্দে মরে যেতে চাইতাম।
৭০ মিনিটের এই রেলগাড়ি ভ্রমণ ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার সময়। নগর জীবনের বাইরে এটি ছিল আমাদের জন্যে দুর্দান্ত একটি দিন।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)