ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের চর্চা আমাদের দেশে আইন আদালত থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে বলতে গেলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। আর সেই ভুক্তভোগী যদি হয় নারী তাহলে তো লারে লাপ্লা। ‘নষ্টা’, ‘পতিতা’, ‘বেশ্যা’ এই শব্দগুলোর কোন পুরুষবাচকতা নেই। আর কোনভাবে ভুক্তভোগীকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করতে পারলে, নামের আগে এসব শব্দ জুড়ে দিতে পারলেই যেন অপরাধ সিদ্ধ হয়, সমাজের মুখ উজ্জ্বল হয়।
হ্যা, কোর্টে একজন অভিযুক্তের পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তিতর্ক ভাল-মন্দ উপস্থাপন করা হয়। তারও একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। কারণ Even a devil has right to get justice. মানে একজন দুশ্চরিত্রারও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধকার আছে। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কেউই অপরাধী নয় অভিযুক্ত মাত্র। অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার সাজা হবে। কিন্তু এই যে অভিযুক্ত হওয়ার পর থেকে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা জনে জনে এজলাস খুলে বসি, আর গণহারে নারীর চরিত্র ধুয়ে দেয়। নষ্টা,পতিতা, বেশ্যা ইত্যাদি দোষবাচক শব্দ জুড়ে দিয়ে প্রকৃত অপরাধী, ধর্ষক, নারী ব্যবসায়ীকে ডিফেন্স করি। দায় মুক্তির পথ দেখায়।
অথচ একবারও এই কমন সেন্সটুকু কাজ করে না এইসব সুন্দরী মেয়েদের খদ্দের কারা? কারা গ্রাম থেকে উঠে আসা এসব অল্প শিক্ষিত, সুন্দরী, মামা-খালুহীন মেয়েদের কাজে লাগিয়ে কারা ব্যবসা করছে, কারা এদের পণ্য বানিয়েছে, কারা এদের ইয়াবা সুন্দরী, মাদক সম্রাজ্ঞী বানিয়েছে? সমাজের তথা কথিত প্রভাবশালী, বিত্তশালী, যারা এক ট্রিপের বিনিময়ে একটি হ্যারিয়ার গাড়ি উপহার দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
কিন্তু কোথাও তাদের চরিত্র নিয়ে কোন সমালোচনার আচঁ তো দূরের কথা নামও মুখে আনতে চান অনেকেই। অথচ সোস্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের স্টলে, গল্পে-আড্ডায়, উঠতে-বসতে, ঘুরতে-ফিরতে মানুষের মুখে মুখে সবচেয়ে সস্তায় নিলামে বিক্রি হচ্ছে নারীর চরিত্র। কৃত অপরাধ নয়, নারীর চরিত্র, নারীত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে। অথচ কিনা আমরা সকলেই জানি নিষিদ্ধ পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, ভোগ, বাজারজাতকরণ এমনকি নিজের কাছে রাখাও অপরাধ।
কিন্তু কথিত মডেল, তারকা, সুন্দরী নারীদের যারা পণ্য হিসাবে খরিদ করছে, ভোগ করছে তাদের চরিত্র বিশ্লেষন তো দূরের কথা ক্ষেত্রবিশেষে প্রভাবশালীদের নাম-পরিচয়ও জানা যায় না। আর ফাঁকফোকর দিয়ে যাদের নাম বেড়িয়েও আসছে তাদের সাধু-সন্ন্যাসী, আল্লার অলি প্রমাণ করতে সমাজের কত আয়োজন। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছেলেধরা, রাক্ষসী, ডাইনি, মায়াজালে আটকে ফাঁদে ফেলেছে টাইপ কথাবার্তা বলে পুরুষের দোষ এড়ানোর যোগাড়যন্ত্র করে সমাজ। একই অপরাধে নারী-পুরুষভেদে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব মতানৈক্যের পক্ষপাতী সমাজপতিরা। আর বিচারক কারা? যারা কিনা রাতে নায়ক, তারাই দিনে বিচারপতি। অন্যভাবে কথাটি যদি ঘুরিয়ে বলি, দিনের বিচারপতিরাই রাতের নায়ক বা খদ্দের। নিজের দায় এড়াতে দোষ ঢাকতে হামলে পড়েন নারীর চরিত্রে দিকে। একজন অপরাধীর ক্ষেত্রে সমাজের এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
আমি কোন বিশেষ শ্রেণিকে প্রটেক্ট করার জন্য কথাগুলো বলছি না বা কোনো অপরাধীকে জাস্টিফাইও করছি না। যে অপরাধী তার শাস্তি হোক সেটা সবার মত আমারও চাওয়া। কিন্তু বিষয়টি যখন স্রেফ লিঙ্গ বৈষম্যের, যখন একের দায় অন্যের ঘাড়ে তখন আর চুপ থাকা যায় না। নারী বলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে পুরুষরা ঠিকই ছাড় পাচ্ছেন। কারণ অশ্লীল স্ত্রীবাচক শব্দগুলোর কোন পুরুষবাচকতা নেই। পুরুষের চরিত্র, মোটিভ খুব একটা আলোচনায় আসেনা। অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী এই দুই শ্রেণীর নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমান। দুইক্ষেত্রেই নারীর চরিত্র সর্বাগ্রে প্রাধান্য পায়। কিন্তু আইনেও অভিযুক্তের চরিত্রকে প্রটেক্ট করা হয়েছে। ভিক্টিম ব্লেমিং বা অভিযুক্তের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, যদি না বিচার্য বিষয় খারাপ চরিত্র হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়া মাত্রই আমরা ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত উভয়ের ক্ষেত্রেই চরিত্র বিশ্লেষক হয়ে যায়৷ কোথাও কোন অডিও-ভিডিও, ছবি হাতে পেলেই রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। যার ভুক্তভোগী হয় অপরাধীর আত্নীয়পরিজনসহ অনেক নিরপরাধ মানুষরাও। অথচ গোপনে কারও ব্যক্তিগত ছবি, অডি, ভিডিও ধারণ ও জনসম্মুখে প্রচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা এসব কাজ করেন এবং যারা এগুলোকে লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন সকলেই আইনের চোখে অপরাধী। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আইনের থোরাই কেয়ার। দেখার কেউ নাই শোনারও কেউ নাই। আইন থাকলেও সুষ্ঠু প্রয়োগের নজীর নাই।
বর্তমানযুগে স্যোস্যাল মিডিয়া এসব অপরাধের অন্যতম প্লাটফর্ম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সমাজে মানুষের মেলামেশার যেমন কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি, বিধিনিষেধ আছে সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মেও তেমনি কিছু সামাজিক নিয়ম আছে।এজন্যই আমরা এটিকে সোস্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলে আসছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে সামাজিক কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করা হয় না ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ম্যাসেনজার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অশ্লীল আলাপ-চারিতা,নোংরা ভাষায় কমেন্ট, মেসেজ, ইমেইল, উদ্দেশ্যপূর্ণ মন্তব্য উল্লেখযোগ্যহারে বেড়ে গেছে। উদাহরণ হিসাবে সোস্যাল মিডিয়ায় সেলিব্রিটিদের কমেন্ট সেকশনে তাকালেই বোঝা যায় আমাদের নৈতিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে চলে গেছে। যে যার মত করে লিখে যাচ্ছে। হাতে বন্দুক পেলে নিরীহ মানুষের চোখ যেমন প্রাণীর উপর পড়ে তেমন। কোন নারী সেলিব্রিটির পোস্টে সবাই ওয়াজ ফরমায়েশ করতে ঝাপিয়ে পড়ে। যেন এখানে দু’চারটা জ্ঞানমূলক গালিগালাজ দিতে পারলেই জান্নাতের টিকিট কনফার্ম।
কোথাও কারও কোনো ব্যক্তিগত অডিও, অন্তরঙ্গ ভিডিও ফাঁস হলে সস্তা স্বাদের মোহে ঝাপিয়ে পড়ে সকলে। লাইক, কমেন্ট, শেয়ারে বন্যা বয়ে যায়। সব দেখে-শুনে মজা নিয়ে নীতির বুলি আওড়ায়। একবারও ভাবিনা তাদেরও পরিবার আছে, আপনার আমার মতই স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বোন আত্নীয় স্বজন আছে। তাদের কি অপরাধ! আপনার আমার এই সস্তা মজার মোহ একজন মানুষকে পারিবারিক ও সামাজিকভা সামাজিকভাবে শুধু হেয় প্রতিপন্নই করে না বরং পরিবার,সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অনেকেই আত্নহননের পথ বেছে নেয়। পরিমনির একজন বয়স্ক নানু আছেন। সাকলায়েন সাহেবের একটি ছোট্ট মেয়ে আছে। আজ হয়তো সে অবুঝ। কিন্তু কাল যখন শিশুটি বড় হয়ে লোকমুখে বাবার অপকর্মের কথা শুনবেন,কষ্টে, যন্ত্রণায়, ঘৃণায় হয়তো বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন। দুদিন আগেও যে স্ত্রী পুলিশ অফিসার স্বামীর গর্বে সমাজে মাথ উচু করে চলেছেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন আজ তিনি লজ্জায় ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। সারাজীবন তাদের সমাজে মাথা নিচু করে বাঁচতে হবে। কিন্তু কি অপরাধ তাদের? কেন সমাজের এই বিরূপ আচরণ? আপনার আমার সামান্য সচেতনা, নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, সৌজন্যমূলক আচরণই পারে সমাজের এইসব নিরপরাধ মানুষদের আশার আলো দেখাতে। বলা হয়ে থাকে, পাপকে ঘৃণা করো, পাপিকে নয়।
যিনি অপরাধ করবেন, প্রচলিত আইনে অবশ্যই তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যদি অশ্লীল ভিডিও তৈরি করে বা প্রচার করে তাহলে সেই দায়ভার একান্তই তার। কিন্তু সেটি ভিউ করে, শেয়ার করে, অশ্লীল মন্তব্য করে আপনি কেন দোষের ভাগিদার হবেন, আশাপাশের মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তুলবেন? এসব করে আপনি কি নিজেকে অলি-আউলিয়া প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? ভুল ভাবছেন, আপনিও একই দোষে দুষ্ট। নগর পুড়ালে, দেবালয় বাদ যায় না। আপনিও এই নষ্ট সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু আফসোস নিজের দোষ চোখে পড়ে না। আমরা নিজের পক্ষে সকলেই উকিল, অন্যের বেলায় বিচারক।
সমাজের দূর্বল শ্রেণির উপর দোষের ভার চাপিয়ে নিজে দায়মুক্ত থাকতে হয়তো পারবেন, কিন্তু বেশিদিন না। মনে রাখবেন সোস্যাল মিডিয়ায় আপনার শিশু সন্তানটিও অবাধ বিচরণ করে। ইউটিউবে ভিডিও দেখে ভাত খায়। আজকে যেটা অন্যদের সাথে ঘটছে কালকে সেটা আপনার সাথে, আপনার স্ত্রী, কন্যা বোনের সাথেও ঘটতে পারে। মনে রাখবেন, অপরাধ যেই করুক না কেন, সে যে শ্রেণি, গোত্র বা লিঙ্গেরই হোক না কেন একজন অপরাধীর পরিচয় সে অপরাধী। তবে অবশ্যই অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষ্। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি অপরাধী, তার আগ পর্যন্ত কেবলমাত্র অভিযুক্ত। তাই কোন অভিযুক্তের চরিত্র বিশ্লেষণ না করে, কারও গোপন অডিও, ভিডিও ভাইরাল না করে পারলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে সহায়তা করুন। আইনের কাজ আইনের হাতেই ছেড়ে দেন। নিজেরা শান্তিতে থাকুন, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুন।
লেখক: সাবিহা আলম মুন্নি, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নিসচা কর্মি, বগুড়া জেলা শাখা।