এসএম আজাদ: ‘আইন মেনে সড়কে চলি,নিরাপদে ঘরে ফিরি’-এই প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২২। সড়ক দুর্ঘটনা কোন বয়স মানেনা,ধর্ম মানেনা,উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা সাধারণ জনগণ কিছুই মানেনা।মুহূর্তের অসতর্কতায় ঘটে যায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা,নীভে যায় জীবন প্রদীপ,থমকে যায় পরিবার। নিহত ব্যক্তি যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হয়ে থাকেন তাহলে তার মৃত্যুতে শুধু পরিবারের গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে ওই পরিবারকে।আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করে তাদের পরিবারের অবস্থা হয় আরো শোচনীয়।পঙ্গু ব্যক্তিকে পরিবারের,সমাজের তথা রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে জীবন কাটাতে হয়। বন্ধ হয়ে যায় সন্তানদের লেখাপড়া চিকিৎসা।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অব রোড সেইফটি ২০১৮ এর তথ্য অনুসারে প্রতিবছর বিশ্বে ১.৩৫ মিলিয়ন মানুষ সড়কে মারা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বে ৮ম বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ; বিশেষ করে ৫-২৯ বছর বয়সের মৃত্যুর এটি প্রধান কারণ। ৯০ শতাংশ মৃত্যু নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে সংগঠিত হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।“দ্যা গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট ২০১৮”অনুযায়ী বিশ্বে মাত্র ১৩২টি দেশ সড়ক নিরাপত্তার জন্য কৌশল অবলম্বন করে।৪৬টি দেশে গতি সম্পর্কিত,৪৫টি দেশে মদ্যপান সম্পর্কিত, ৪৯টি দেশে হেলমেট সম্পর্কিত,১০৫টি দেশে সিটবেল্ট এবং ৩৩টি দেশে শিশুদের জন্য নিরাপদ আসন সম্পর্কিত আইন প্রচলিত আছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা এর ২০৩০ সালের পরিকল্পনায় ৩.৬ এবং ১১.২ অভীষ্ট লক্ষ্য হলো যথাক্রমে আন্তর্জাতিকভাবে আহত ও নিহতের সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং সবার জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত, সহজলভ্য এবং টেকসই জীবন নিশ্চিত করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই উদ্যোগের সাথে একাত্ত্বতা ঘোষনা করেছেন। নিরাপদ ও ভ্রমণবান্ধব সড়ক গড়ে তোলা সরকারের অগ্রাধিকার।এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং জাতিসংঘ ঘোষিত দ্বিতীয়বারের মতো ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আইনগত কাঠামো শক্তিশালী করা হয়েছে এবং প্রণয়ন করা হয়েছে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। আইনটি এবছর আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
তাই আলোচ্য সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো নিরসনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আইনে অর্ন্তভূক্ত করা প্রয়োজন:
১)গাড়ীর সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা(যেমন-শহরে সর্বোচ্চ ৪০ কি.মি.,হাইওয়েতে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের জন্য ৯০ কি.মি.,হাইওয়েতে বড় ও ভারী পরিবহন বাস,ট্রাকের জন্য ৮০ কি.মি. পথচারীদের পারাপার সড়কে ৩০ কি.মি.গতিসীমা আইনে নির্ধারন করে দেওয়া); স্থানীয় সরকারকে সর্বনিম্ন গতিসীমা নির্ধারনে নির্দেশনা প্রদান;গাড়ির গতিসীমা ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন প্রনয়ণ।
২)মদ্যপান/মাদক সেবন করে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে কোন চালক মদ্যপায়ী/মাদক সেবন করছে কিনা তা নির্ণয়ে আরবিটি এবং ডোপটেস্ট পদ্ধতির মাধ্যমে জিরো টলারেন্সে থাকা।
৩)মোটরসাইকেল আরোহীর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ০২ জন এবং হেলমেট পরিধানের ক্ষেত্রে চালক ও আরোহী উভয়ের জন্য বাধ্যতামূলক সেই সাথে বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দেওয়া।
৪)গাড়ি বা যানবাহনে চালকসহ সকল যাত্রীদের (সামনের ও পিছনের সিটের) সিট বেল্ট পরিধান বাধ্যতামূলক করা, পুরাতন যানবাহনে রেট্রফিটিং এর মাধ্যমে সকলের জন্য সিট বেল্টের ব্যবস্থা রাখা এবং
৫)প্রাইভেট কারে এবং পরিবহনে শিশুদের জন্য নিরাপদ/সুরক্ষিত আসন সিস্টেম চালু করা বিশেষ করে ১২ বছরের নিচে শিশুদের জন্য।
নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা যেমন ক্রমাগত বাড়ছে, তেমনি দ্রুত গতিতে বাড়ছে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি।উদাহরণস্বরূপ,সাম্প্রতিককালে জাম্বিয়ার অর্থনীতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তাদের জিডিপির ৩ শতাংশ।বাংলাদেশে জিডিপির প্রায় ২.৫% যা টাকায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমান।
অর্থনীতিতে সড়ক দুর্ঘটনার দৃশ্যমান (tangible) ও অদৃশ্যমান (intangible) উভয় ধরনের ক্ষতি রয়েছে। দৃশ্যমান ক্ষতির মধ্যে রয়েছে–যানবাহনের ক্ষয়-ক্ষতি (প্রতিস্থাপন ও মেরামত খরচ),প্রশাসনিক খরচ, চিকিৎসা-ব্যয়, মৃত্যু কিংবা আহত হওয়ার কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়া, বীমা-খরচ ইত্যাদি। অন্যদিকে অদৃশ্যমান ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে রয়েছে–যন্ত্রণা,দুর্দশা,দুর্ভোগ এবং দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ঝুঁকি।
রাস্তায় উন্নত পর্যায়ের নিরাপত্তা এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বিষয়টি অনেকগুলো উপাদানের উপর নির্ভর করে।এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ট্রাফিক আইন-কানুনের কার্যকরী প্রয়োগ।বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা তার স্ট্যাটাস রিপোর্টে বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে যা বলছে তা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। সংস্থার র্যাং ক অনুযায়ী,আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শূন্য থেকে নয় স্কেলে ৪ নম্বর অবস্থানে আছে।
পৃথিবীর যেসব দেশে সড়ক নিরাপদ রাখার জন্য কোনো আচরণবিধি বা কোড নেই, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।এ ধরনের আচরণবিধি যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশেই রয়েছে এবং দেশের প্রতিটা নাগরিক তা যথাযথভাবে মেনেও চলেন।নিরাপদ সড়ক আচরণবিধি হচ্ছে সেই ডকুমেন্ট,যেখানে কোন্ আইনের কোন্ ধারা লঙ্ঘনে কী ধরনের দণ্ড রয়েছে তা উল্লেখ করাসহ সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহনের চালক, হেলপার,যাত্রী,পথচারী,ট্রাফিকপুলিশসহ সব ধরনের রাস্তা ব্যবহারকারী কোন্ পরিস্থিতিতে কী ধরনের আচরণ করবে তা বর্ণিত থাকে।
এই আচরণবিধি কীভাবে জনসাধারণের মাঝে প্রচারণার মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে,প্রচারণার দায়িত্বে কারা থাকবে,কীভাবে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে,গাড়িচালনা শেখার স্কুলগুলোতে কীভাবে বাধ্যতামূলক পাঠ্য করতে হবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সেখানে সময়ানুগ এবং সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
পরিশেষে আশাবাদ,নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকা এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ একদিন আমরা একটা নিরাপদ সড়ক আচরণবিধি হাতে পাব,যা সড়কে অযাচিত দুর্ঘটনা বা বিপত্তি থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।পাশাপাশি,সড়ক নিরাপত্তা বিষয়টি উন্নয়নের মূলধারার কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে সরকারি কর্মপরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
লেখক- সাংবাদিক,কলাম লেখক ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, নিরাপদ সড়ক চাই