করোনা ঠেকাতে লকডাউন। তাতে করোনার সাময়িক প্রকোপ কমলো, কিন্তু ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শ্রমিক, কারিগর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যে ত্রাহি অবস্থা আমরা দেখছি, তাতে আমাদের এই অর্থনীতি লকডাউনের চাপ কতটা নিতে পারবে তা ভাবা দরকার।
লকডাউনে রফতানি শিল্পসহ বেশকিছু জরুরি শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা আছে, ফলে তাদের ক্ষতি কম। কিন্তু নানান পণ্য উৎপাদনকারী অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র পণ্যের উদ্যোক্তা যারা ঈদসহ নানা উৎসবকে ঘিরে তাদের পণ্য বিক্রয় পসরা সাজান-তারা পড়েছেন মারাত্মক বিপাকে। সেই সাথে আছে রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, পার্লার, নানা রকম আইসিটি সম্পৃক্ত সেবা-যারা তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারছেন না। এই সকল উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত আছে লাখ লাখ কারিগর-শ্রমিক-কর্মচারী। এসকল খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষে তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন কতদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? বড় উদ্যোক্তাদের যেখানে শ্রমিকের বেতন দেওয়ার জন্য সরকারের সাহায্য নিতে হয়, তাহলে এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কিভাবে সেই বেতন চালিয়ে যাবেন?
গতবছরের প্রণোদনা প্যাকেজের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টন হয়েছে খুব ধীরগতিতে। এখনো পর্যন্ত ৭৫ ভাগ এর মত বণ্টিত হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা সেই সুবিধা পাননি। বিশেষ করে যাদের ব্যাংকের সাথে লেনদেন নেই কিংবা যাদের ব্যবসার ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছিল, তারা কিন্তু এই প্রণোদনার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন। তারা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। সেই অবস্থায় পণ্য বিক্রি করতে না পারলে এই উদ্যোক্তা এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা কাজ হারিয়ে, আয় হারিয়ে মারাত্মক সংকটে পড়তে পারেন।
আবার যারা প্রণোদনার ঋণ সুবিধা পেয়েছিলেন, তারা যদি এখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না পারেন, তাহলে ঋণের টাকা ফেরত দেবেন কিভাবে, সেটিও চিন্তার ব্যাপার।
দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, দোকানপাট মার্কেটের ফরমায়েশ খাটা কর্মী, দারোয়ান, কুলি, মুচি, ঝালমুড়ি বিক্রেতা-এই সাধারণ মানুষগুলো কতদিন এভাবে চলতে পারবেন?
অন্যদিকে বাস্তবতা হলো লকডাউন দিয়ে করোনাকে কিছুটা দমানো গেলেও এটা স্পষ্ট যে করোনার সাথে আরো হয়তো অনেক মাস কিংবা বছর আমাদের বসবাস করতে হবে। এখনো পর্যন্ত মাত্র ৩% জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা গেছে। যতদিন পর্যন্ত না প্রাপ্তবয়স্ক সকলকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যায়, ততদিন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় পন্থাগুলো ভাবতে হবে। আবার ভ্যাকসিন সবাইকে দেওয়া গেলেও তা সবার জন্য পুরোপুরি কার্যকর নাও হতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
সেক্ষেত্রে আমাদের অন্তত এক বছরের একটা সার্বিক করোনা মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে এভাবে দিনের পর দিন লকডাউন থাকলে তার অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করা অনেক মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। আমাদের বুঝতে হবে এই লকডাউনের পরেই করোনা বিদায় নিচ্ছে না।
করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ব্যাপক ও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করাই হচ্ছে উপায়। ঘরের বাইরে অফিস-আদালতে এবং পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
অতি দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য গত বছরের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে, খাদ্য বিতরণের আওতা বাড়াতে হবে। এই হতদরিদ্র মানুষদের অনেকের কাছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে জীবনের ঝুঁকির চেয়েও খাদ্য কষ্টের চিন্তা অনেক বেশি প্রকট।
যেসকল খাতকে লকডাউনের আওতায় মধ্যে রাখা হয়েছে অর্থাৎ যারা তাদের ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারছেন না তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। এদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে ঋণ নিয়েছেন তার ফেরত দেওয়ার সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সুবিধা দিতে হবে।
যে সকল খাত লকডাউনের আওতার বাইরে আছে অর্থাৎ যারা তাদের উৎপাদন কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন, তাদেরকে আর কোনও নতুন প্রণোদনা দেওয়া যাবে না, কিংবা তাদের ইতোমধ্যে গৃহীত ঋণের অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন নাই।
স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থাতে আমরা দেখেছি যে, বাংলাদেশের উন্নয়নের উজ্জ্বল চিত্রের পাশাপাশি দুর্বল দিক হচ্ছে আয় বৈষম্য। সেই আয় বৈষম্য আরো বাড়বে যদি আমরা বড় বড় উদ্যোক্তাদের শুধু লকডাউনের আওতায় বাইরে রাখি, আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা হিমশিম খেতে থাকে বেঁচে থাকার জন্য। তাই আগামীর প্রণোদনা হতে হবে শুধু এই অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ।
স্বাস্থ্য বিধি মানা কঠোরভাবে আরোপ করতে দরিদ্র মানুষের মধ্যে মাস্ক ও সাবান বিতরণ করতে হবে; স্বাস্থ্যবিধি মানার গুরুত্বের বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে। আগামী অন্তত এক বছর কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে শিথিলতা আনা যাবে না। এটি পালন করতে পারলে সহসাই আবার লকডাউন দেওয়ার প্রয়োজন হবে না ।
এদেশে অনেক স্বচ্ছল মানুষ আছেন যারা মাসের পর মাস ঘরে থাকতে পারবেন, কোনো কাজ না করলেও জীবনযাপনের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখা কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে তা সম্ভব না । সরকারের পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী বিত্তবানদেরকেও এই মানুষগুলোকে সাহায্য করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আর সকলের প্রতি আহ্বান, যাদের সামর্থ্য আছে তারা যত বেশি পারেন দেশীয় পণ্য কিনুন। তাতে এদেশের অনেক কারিগর, ডিজাইনার, শ্রমিকসহ পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের সাথে জড়িত নানামুখী মানুষের আয় বাঁচাতে, পেশা বাঁচাতে তা ভূমিকা রাখবে।
মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে আরো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় এগিয়ে নিতে হবে।
লেখিকাঃ অর্থনীতিবিদ