১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার যাত্রা শুরু করে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অগ্রাধিকার তালিকায় স্থান পায় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ১৯৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়নের শুরু সরল পথে হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এই সেতুর বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্থ করে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামাত জোটের শাসনামলে পদ্মা সেতু নির্মাণের গতি শস্নথ হয়ে পড়ে। বিশদ সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে জাইকা মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের সুপারিশ করে। কিন্তু বিএনপি-জামাত জোট সরকার এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ায় কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তারা বিশদ সমীক্ষার আলোকে পদ্মা সেতু প্রকল্প একনেকের সভায় পাস করেনি।
এর কারণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণের এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণ অঙ্গীকার আকারে অন্তর্ভুক্ত করেন। দেশের মানুষের সৌভাগ্য যে, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। তিনি আবারও পদ্মা সেতু নির্মাণ অগ্রাধিকার দিয়ে তার বাস্তবায়ন দ্রুততর করার উদ্যোগ নেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পদ্মা সেতু প্রকল্প দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। বিশ্বব্যাংক একটি কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগের জন্য বার বার সুপারিশ করে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বুয়েটের বরেন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মূল্যায়ন কমিটি কালো তালিকাভুক্ত ওই কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগে রাজী ছিলেন না। বিশ্বব্যাংকের বার বার সুপারিশে পরামর্শক নিয়োগ বিলম্বিত হয়। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে, তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছে, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অভিযোগের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বিশ্বব্যাংককেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে বলেন। বিশ্বব্যাংক কানাডিয়ান এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডিয়ান রয়েল মাউন্টেড পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে। পরবর্তীতে কানাডিয়ান আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করেন। প্রশ্ন হলো যে প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ তার বাস্তবায়নেতো একটি টাকাও রিলিজ করা হয়নি। তাহলে দুর্নীতি কোথায়? সচেতন মহল থেকে এমন প্রশ্নও উচ্চারিত হতে থাকে। আসলে এর নেপথ্যে ছিল সুগভীর ষড়যন্ত্র। ঋণ বাতিলের এই সিদ্ধান্ত শুধু বিশ্বব্যাংকের একার নয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুশীলবদের প্রভাব এতে কাজ করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের কপালে দুর্নীতির কালিমা লেপন করে দেশে-বিদেশে ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা এবং বিরোধী দলের হাতে আন্দোলনের অস্ত্র তুলে দেওয়া, যাতে আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত হয়। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয় বিরোধী রাজনীতিক এবং নোবেল লরিয়েটসহ সুশীল সমাজের চিহ্নিত কতিপয় ব্যক্তি, যারা এক এগারোর সময় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চেয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল পরবর্তী কার্যক্রমগুলোর ওপর আলোকপাত করলে ষড়যন্ত্রের গভীরতা আরও স্পষ্ট হবে। পুনরায় ঋণ পেতে বিশ্বব্যাংক সরকারকে একের পর শর্ত দিতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের দাবী অনুসারে সরকার সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের দাবী তোলে এবং তাকে কারাগারে যেতে হয়। তিনি চাকুরিও হারান। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহামানকে ছুটিতে যেতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। লক্ষনীয় যে, দেশের আলোচ্য চিহ্নিত বিরোধী রাজনীতিক, নবেল লরিয়েটসহ সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণে সচেষ্ট হয়। তারা বিবৃতিও দেয়। অভিযোগ রয়েছে কথিত নবেল লরিয়েট একটি প্রভাবশালী দেশকে দিয়ে বিশ্বব্যাংকের ওপর প্রভাব খাটিয়ে ঋণ বাতিল করান। পুনরায় ঋণ পেতে নেপথ্যের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থান নেন। তিনি ২০১২ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। এটি ছিল সময়োপরযাগী সাহসী উচ্চারণ, যা দেশ-বিদেশে সকল মহল কর্তৃক সমাদৃত হয়। এরই ধারবাহিকতায় ২০১৩ সালে ৩১ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট এবং এডিবি, জাইকা এবং আইডিবিকে লেখা দুটি পত্রে পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের অর্থায়নের প্রয়োজন নেই বলে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। ২০১৫ সাল থেকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। এই নির্মাণযজ্ঞ চলার মধ্যেই কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সরকার সাত বছরে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে যেয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু তা হয়নি। প্রকৃত সত্য হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, সাহস ও সততার কাছে ষড়যন্ত্র পরাভূত হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। তাই পদ্মা সেতু কেবলই একটি সেতু নয় এটি জননেত্রী শেখ হাসিনার সততা ও সাহসিকতার প্রতীক।
লেখক: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী