নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর প্রতিষ্ঠিাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নিজের পয়সায়, নিজের শ্রম দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে নিসচা। মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে আমরা এ কাজ করছি। সড়ক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করছে সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সদিচ্ছার ওপর। আমরা সবসময় সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছি। এটি একটি জাতীয় ইস্যু। মানুষ সড়কে জীবন দিচ্ছে। এই ইস্যুতে সব দলকে এক হতে হবে যা অতীতে কখনও হয়নি।
সংগঠনের ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
আলোচনায় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা সড়ক নিরাপত্তার নানা দিক নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাকে সব সময় একটি ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। আমি বিএনপির কাছে গেলে বিএনপির ট্যাগ, জামায়াতের কাছে গেলে জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হতো অতীতে। ৩২ বছর ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু সড়কে বিশৃঙ্খলা থেকে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আজকে যিনি সড়ক উপদেষ্টা রয়েছেন, তিনি এ সেক্টরে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আজকে আমার মতো আপনাদের স্ত্রী মারা গেলে আপনারাও এটিকে গুরুত্ব দিতেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গত সাড়ে তিন মাসে সড়ক নিরাপত্তায় কোনো কাজ হচ্ছে না। যেভাবে করা দরকার সেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ হচ্ছে না। অন্তর থেকে কাজ করতে হবে।
সড়ক নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয় একটি চিন্তা দরকার: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম বলেন, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন এখনও সময়ের দাবি। ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর প্রচেষ্টায় সারা বাংলাদেশে আন্দোলন করছেন। সড়ক নিরাপত্তায়রাষ্ট্রীয় একটি চিন্তা দরকার। কিন্তু তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উল্টো ইলিয়াস কাঞ্চনকে হেনস্তা করা হয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিকতা আনা হয়নি। পানিপথ, রেলপথকে বাদ দিয়ে শুধু সড়কের ওপর জোর দিয়ে সমাধান হবে না। সড়কে যাত্রী বাড়ছে, নৌপথে যাত্রী কমছে, গাড়ি কমছে। নৌ ও রেলপথে যেভাবে দৃষ্টি দেওয়া উচিত সেটা করা হয়নি।
তাহলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যেত। পরিবেশও নিরাপদ থাকতো। সড়কের মাফিয়া চক্র যারা অতীতে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। সড়কে যারা এখনও অনিয়ম, দুর্নীতি করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির নামে যারা এসব করছে তাদের আইনের আওতায় আনছেন না কেন?
সড়কের দুর্নীতি নিয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে: আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনি বলেন, বিআরটি’র সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে যুক্ত। একজন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী দিয়ে এটি সমাধান সম্ভব নয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স, রুট পারমিট এগুলোতে দুর্নীতি হচ্ছে। এগুলো নিয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে।
সড়ক নিরাপত্তায় চার সুপারিশ: জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুর রহমান মাসুদ বলেন, নিরাপদ সড়ক বিনির্মাণের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। নিরাপদ সড়কের জন্য দরকার নিরাপদ রাষ্ট্র, নিরাপদ শাসক, নিরাপদ সড়ক। সড়কে বাসের নিচে জীবন দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। তিনি সড়ক নিরাপত্তার চারটি সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, এজন্য নাগরিক শ্রেণির মধ্যে মূল্যবোধের জন্ম দিতে হবে; ব্যক্তিকে নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালকদের লাইসেন্স দিতে হবে। কোনো চালক যাতে ভুল করলে তাকে নয়, প্রতিষ্ঠানকে ধরতে হবে; মানবিক মূল্যবোধের মর্যাদা সৃষ্টি করতে হবে এবং ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে।
ইলিয়াস কাঞ্চনকে প্রধান করে কমিশন গঠনের প্রস্তাব: নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আজাদ বলেন, ৩২ বছর ধরে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, সরকারে যাওয়ার জন্য নয়, সামাজিক একটি দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে গেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। আমাদের দেশের বাস্তবতায় একজন মানুষের পক্ষে এত বছর ধরে আন্দোলন করে যাওয়ার নজির খুবই কম। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ইলিয়াস কাঞ্চনকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করছি যাতে আমরা দেশে নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে পারি।
রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সড়কে অনিয়ম: গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ঢাকায় সড়ক
দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ওভারটেকিং, বেপরোয়া গতি, অদক্ষ চালক ও চালকদের মানসিক উদ্বেগ। আমাদের দেশে এই বিষয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাধানের কোনো অথরিটি নাই। সরকারের অনেক বিভাগ আছে, তাদের অনেক কাজ আছে, কিন্তু পদক্ষেপ নেই। যে দেশে ট্রাফিক সিস্টেম যত ভালো, সেসব দেশে আইনের শাসন তত ভালো। আমাদের দেশে যেখানে সেখানে পার্কিং, ফুটপাত দখল করে দোকান বসানো- এসব অনিয়ম মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এসব অনিয়ম ঘটছে। হরতাল অবরোধের সময় পরিবহন সেক্টরের সিন্ডিকেট সরকারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যক্তির হাত বদল হয়েছে, সিস্টেমের পরিবর্তন হয়নি। দুর্নীতি-চাঁদাবাজি চলছেই। এখন অন্যরা নিচ্ছে। তিনি বলেন, ইলিয়াস কাঞ্চন সিনেমার হিরো ছিলেন, এখন তিনি বাস্তবের নায়ক। শাহজাহান খানরা সিন্ডিকেট করে লাইসেন্স দিয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। এজন্য লাঞ্ছিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন। গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার চেহারা পাল্টানোর সুযোগ এসেছে। রাজনীতিবিদদের চেহারা আমরা দেখেছি। বিরোধী দলে গেলে কি বলে, আর সরকার গেলে কি বলে?
রাজনৈতিক নেতাদের আন্তরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান: সড়কের দুর্ঘটনা বন্ধে রাজনৈতিক নেতাদের আন্তরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি বলেন, দুটি বাসের রেষারেষিতে পথচারী নিহত হওয়াকে আমি দুর্ঘটনা বলতে চাই না। এ রকম দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক। এটিকে হত্যা, গণহত্যা বলতে চাই। আইনকে আইনের গতিতে চলতে দিতে হবে। ড্রাইভার মোবাইল ফোনে কথা বলছে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালাচ্ছে, চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালাচ্ছে, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলছে। এগুলো দেখার কেউ নাই। এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনা থামছে না।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, নিরাপদ সড়কের জন্য ইলিয়াস কাঞ্চনের অবদান অনেক। সড়ককে নিরাপদ করার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে কাজ করতে হবে।