ইলিয়াস কাঞ্চন আজ ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ নিরাপদ সড়ক চাইয়ের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবে সকাল ১১.৩০ টায় সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন নিসচার কার্যনির্বাহী সদস্য মোঃ রোকনুজ্জামান রোকন। শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন যুগ্ম মহাসচিব মোঃ গনি মিয়া বাবুল। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মহাসচিব লিটন এরশাদ। পরিচালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আজাদ হোসেন। মূল বক্তব্য উত্থাপন করেন নিসচা প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন নিসচার ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন খান নান্টু, দপ্তর সম্পাদক ফিরোজ আলম মিলন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোঃ মফিজুর রহমান খান বাবু, সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোঃ মোহসিন খান, নির্বাহী সদস্য একে আজাদ, কামাল হোসেন খান, আবদুর রাজ্জাক, উত্তরা শাখার সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সদস্য বিকাশ দাস গুপ্ত, কবির খান, শাহজালাল, আবদুল মান্নান প্রমুখ।
বক্তব্যে নিসচা চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন এখন থেকে তিনি তার সংগঠন থেকে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করবেন না। তিনি বলেন, আমাদের দেখাদেখি অনেকে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থপান করছে এবং নানা বিতর্ক তৈরি হচ্ছে তখন এ বছর এসে আমি ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান আর তুলে না ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ একেকজনের ডাটায় একেক রকম তথ্য প্রকাশ হতে থাকে তখন থেকেই বিতর্কের শুরু বলে মনে করি। কারণ এসব সংগঠন কখনই আমাদের মত করে তাদের রিপোর্ট নিয়ে বলতে শুনিনি এটাই যথেষ্ট বা পুরোপুরি সঠিক নয়। এটা একটা চিত্র মাত্র।
তিনি আরও বলেন, সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত পরিবহন সংক্রান্ত আইন। তাই উল্লিখিত বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়নে এই আইন ও বিধিমালা যথেষ্ট নয়। এজন্যই প্রয়োজন জাতিসংঘ প্রস্তাবিত বর্ণিত ৫টি স্তম্ভ এবং আচরণগত ঝুঁকির কারণসমূহ বিবেচনায় নিয়ে একটি নতুন সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয়ে সরকারি সমন্বিত উদ্যোগ বিশেষ করে স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র ও সড়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠন করে যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে তা দূর করে সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এগিয়ে আসবেন।
মূল বক্তব্য
নিরাপদ সড়ক চাইয়ের দীর্ঘ ৩০ বছরের পথচলায় আপনারা বরাবরই আমার সকল কর্মকা-ে ব্যাপক সহযোগিতা করে আসছেন। আমি এবং আমার সংগঠনের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি আশা করি আপনাদের এই সহযোগিতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আজ একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার এবং সড়ক নিয়ে কাজ করার যে ইতিহাস রচিত হয়েছে সেই ইতিহাসের পথপ্রদর্শক আমরাই। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নামে এই আন্দোলনটির মাধ্যমেই এই ইতিহাসটির সূচনা।
যদিও ইতিহাসটির সূচনার একটি বিয়োগান্তক পরিণতি রয়েছে তারপরও সেখান থেকে জনকল্যাণে যে ভালো কিছু করা যায় তার একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ তথা সারাবিশ্বে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পথচলায় সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে শুধু জনমত তৈরীই নয় সড়ক দুর্ঘটনার কারণ এবং তার প্রতিকার ও সুপারিশমালাসহ নানা কর্মকান্ড পর্যায়ক্রমে করে আসছি। এই পেক্ষাপটে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ২০১২ সাল থেকে যে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করে আসছে, সেদিন থেকে আমরা সরকার ও দেশবাসীকে জানিয়ে আসছি এই কাজটি আমরা আমাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে শুরু করেছি।
সারাদেশে আমাদের যতগুলো শাখা রয়েছে তাদের দেয়া তথ্য এবং পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল-এর সংবাদ ও বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করে আমরা এই তথ্য সংগ্রহ করতাম। সেইসাথে বলেও আসছি এটা পর্যাপ্ত নয় এবং ডাটা সংগ্রহের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। আমরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করছি সেটা সেকেন্ডারী তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করে আসছি। ২০১২ সাল থেকে ‘সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান’ ২০২২ সাল পর্যন্ত জাতির সামনে তুলে ধরেছি। কিন্তু যখন দেখলাম আমাদের দেখাদেখি অনেকে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থপান করছে এবং নানা বিতর্ক তৈরি হচ্ছে তখন এ বছর এসে আমি ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান আর তুলে না ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেন? কোন প্রেক্ষাপটে আমি আমার সংগঠনের পক্ষ থেকে আর সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করবোনা বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে ব্যাখ্যাই আমি আপনাদের দিবো এবং আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাবো।
আমরা শুরু করেছি, আমরা পথ দেখিয়েছি। শুরু থেকে আমরা প্রতিনিয়ত সরকারের কাছে একটি দাবি জানিয়ে এসেছি, এটি কোন বেসরকারি সংগঠন বা কোন ব্যক্তির পক্ষে প্রকৃত চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য সরকারের একটি সার্বক্ষনিক মনিটরিং সেল এবং লোকবলের প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও প্রযুক্তিগত ডেভেলপমেন্টেরও দরকার রয়েছে- যা কোন ব্যক্তি উদ্যোগে করা সম্ভব নয়। মোটকথা এখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতা অপরিহার্য। যদিও প্রতিবছর পুলিশ তাৎক্ষণিক মামলার ওপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট প্রদান করতো। সে রিপোর্ট আর আমাদের রিপোর্টের সাথে ছিল বিস্তর ফারাক। পুলিশের এই রিপোর্টটি আমরা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতাম না কারণ, এই রিপোর্ট তৈরী করা হয় শুধুমাত্র মামলার ওপর ভিত্তি করে অর্থাৎ যে দুর্ঘটনার মামলা করা হতো শুধুমাত্র সেই দুর্ঘটনার তথ্যই ঐ রিপোর্টে থাকতো।
অনেকক্ষেত্রে দেখা যেতো নানা কারণে অনেক দুর্ঘটনার মামলা হতো না। যেমন আমার স্ত্রী দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। পুলিশের রিপোর্টে তো সেটা ছিলোনা। আবার কোন দুর্ঘটনায় আহত যারা হয় তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৩০ দিনের ভেতরে মারা গেলে সেই তথ্য সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে বিবেচিত হবে। আমাদের দেশে সেটা পুলিশ উল্লেখ করে না। এ কারণে এই ডাটাটির কোন গ্রহযোগ্যতা আছে বলে আমরা মনে করিনা। তাছাড়া আমাদের দেখাদেখি অনেক সংগঠন বাহবা কুড়াতে যখন দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দিতে শুরু করে এবং একেকজনের ডাটায় একেক রকম তথ্য প্রকাশ হতে থাকে তখন থেকেই বিতর্কের শুরু বলে মনে করি। কারণ এসব সংগঠন কখনই আমাদের মত করে তাদের রিপোর্ট নিয়ে বলতে শুনিনি এটাই যথেষ্ট বা পুরোপুরি সঠিক নয়। এটা একটা চিত্র মাত্র।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারাবিশ্বের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে থাকে। তাদের দেয়া তথ্য মতে সড়ক দুর্ঘটনা তথা রোডক্র্যাশে প্রতি বছর সারা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ লাখ ছুঁই ছুঁই। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বছরে ১১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ নিহত হয়। প্রতি মিনিটে বিশ্বে ২ জন ব্যক্তি এবং দিনে মৃত্যু হয় ৩ হাজার ২০০ জনের। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ সড়ক দুর্ঘটনা বা রোডক্র্যাশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০২৩’- এ এসব তথ্য উঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী সকল বয়সের মানুষের মৃত্যুর ১২তম প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। একই সঙ্গে কর্মক্ষম ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর কারণও রোডক্র্যাশে। প্রতি লাখে এই মৃত্যুর হার ১৫ শতাংশ। মৃত্যুর পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যাও অনেক। দুই থেকে পাঁচ কোটি মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়। অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে দক্ষিণ-এশিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে।
শতকরা হিসাবে এটি ২৮ শতাংশ। বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের (৯২ শতাংশ) মৃত্যু হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এবং নি¤œ আয়ের দেশগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ৩ গুণ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রোডর্ক্যাশে হতাহতের চিত্র প্রায় একই রকম। রোডক্র্যাশে হতাহতের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে বিশ্বে গড়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশ জিডিপি’র ক্ষতি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০২৩’ এ আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা বা রোডক্র্যাশে মৃত্যু হয়েছে, ২১ হাজার ৩১৬ জনের। তবে পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৭৬ জনের।
একইভাবে ২০১৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৬৩৫ জনের। ২০২১ সালের রিপোর্টে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মৃত্যু হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৬ সালে প্রতি লাখে মৃত্যুহার ছিল ১৫.৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৪৯৫ সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২৪ জন। পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে ওই বছর ৫ হাজার ৯৩ দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৭৫ জন নিহত। আরও দুই একটি সংগঠনের তথ্যও এরচেয়ে অনেক বেশী। আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে সেটিও প্রত্যেক রিপোর্টের সাথে মিলছে না। এতে করে দেখা যাচ্ছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সরকার, পুলিশ ও বিভিন্ন রিপোর্টে ভিন্নতা রয়েছে। আমরা মনে করি এতে করে জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছে। কারণ সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিশ^ স্বাস্থ সংস্থা ও বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠনের সকল তথ্যকে অগ্রহণযোগ্য বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানের যে ধারা আমরা শুরু করি এবং টানা ১১ বছর চলমানও রাখি।
কিন্তু ভাবনার জায়গায় আমরা কখনই স্থির হতে পারিনি। পারিনি বলেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হচ্ছে আমরা উপরেল্লিখিত এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করবো না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র চেয়ারম্যান জনাব নুর মোহাম্মদ মজুমদার বিশ^ স্বাস্থ সংস্থা ও বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠনের দেয়া তথ্যকে যখন অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করে বলেন, এতে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা যে রিপোর্ট প্রকাশ করছে সেখানে তারা আমাদের দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দ্বারা এই তথ্য উপাত্ত্ব সংগ্রহ করছে। যার উপর ভিত্তি করে এই তথ্য তারা প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু সরকারের আরেকটি সংস্থা বিআরটিএ ও সড়ক মন্ত্রণালয় যখন এই তথ্যকে অবাস্তব বলতে চায় তখন আমরা বিভ্রান্ত হই। শুধু আমরা নই জাতিও বিভ্রান্ত হয়।
আমার প্রশ্ন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও সরকারের, সড়ক মন্ত্রণালয়ও সরকারের। তাহলে দুটি মন্ত্রণালয়ের সড়ক দুর্ঘটনার ডাটার হিসাব ভিন্ন ভিন্ন কেন? আমরা মনে করি সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ের এই পার¯পরিক বিরোধী অবস্থার কারণে দেশে সঠিকভাবে দুর্ঘটনা নিরসনের কারণ উদঘাটন করা যায়নি। এই কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখনও আমাদের দেশে একটি বিষ ফোড়ার মতো হয়ে আছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিসংখ্যান দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতি বছরই বিগত বছরের রেকর্ড ভাঙছে। মৃত্যুর পাশাপাশি আহতের তালিকাও বেড়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ হচ্ছে। এই সমস্ত কারণে আমরা তখন থেকেই মনে করে আসছিলাম আমরা যে কাজটি শুরু করেছি সরকারকে পথ দেখাতে সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগী হোক। সরকার এই বিষয়ে কাজ শুরু করুক। সরকার গতবছর থেকে কাজটি শুরু করেছে। তবে বেসরকারি ভাবে ডাটা উপস্থাপনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এতে করে এই জাতির বিভ্রান্তি কাটবে না বলে মনে করি। কিন্তু যদি কোন রোগ নিরাময় করতে চাই সে রোগের যদি আমি প্রকৃত কারণ এবং রোগটির বিস্তার কতটুকু সেগুলো যদি না জানি তাহলেতো আমি চিকিৎসা করতে পারব না।
সেক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যত্যয় ঘটবে। এখানে সড়ক দুর্ঘটনার ডাটার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল কোন জায়গা থেকে শুরু করবে এই প্রশ্নও রাখছি। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমি গত বছর থেকে ভাবছিলাম, কি করা যায়, সরকারি উচ্চমহলেও আমার কথা হয়েছে। সরকার যেহেতু বিআরটিএ’র মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। আমি আমার সংগঠন থেকে আর এই তথ্য প্রকাশ করবোনা। আমাদের সেল চালু থাকবে নিজস্ব গবেষণার জন্য। তবে সরকারের প্রতি আহবান থাকবে বেসরকারি যে সমস্ত এক্সপার্ট আছে তাদেরকে এই উদ্যোগের সাথে সামিল করে একটা শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠন করার। এক্ষেত্রে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরার যে ধারা আমরা শুরু করেছি সরকার যদি আমাদের সাপোর্ট এবং আর্থিক বরাদ্দ দেয় তাহলে আমরাও সরকারের সাথে এ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারবো এই বিশ^াস আমাদের আছে। আমরা আরও বলতে চাই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সড়ক দুর্ঘটনা বা রোডক্র্যাশকে প্রতিরোধযোগ্য একটি অসংক্রামক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ ছাড়াও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩.৬ অর্জনে ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা বা রোডক্র্যাশে প্রাণহানির সংখ্যা ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক পর্যায়েও ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘভুক্ত সদস্য দেশগুলো বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা বা রোডক্র্যাশে নিহত ও আহতের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-২০৩০ এর আওতায় ৫টি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো- বহুমুখী যানবাহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার, রোডক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ছাড়াও সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য ৫টি আচরণগত ঝুঁকি যেমন, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ না করা, সিট বেল্ট ব্যবহার না করা, মানসম্মত হেলমেট পরিধান না করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশুবান্ধব বিশেষায়িত আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ২০১০ থেকে ২০২১ সালে বেলারুশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়ান ফেডারেশন, ত্রিনিদাদ, টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনিজুয়েলা রোডক্র্যাশে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত পরিবহন সংক্রান্ত আইন।
তাই উল্লিখিত বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়নে এই আইন ও বিধিমালা যথেষ্ট নয়। এজন্যই প্রয়োজন জাতিসংঘ প্রস্তাবিত বর্ণিত ৫টি স্তম্ভ এবং আচরণগত ঝুঁকির কারণসমূহ বিবেচনায় নিয়ে একটি নতুন সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয়ে সরকারি সমন্বিত উদ্যোগ বিশেষ করে স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র ও সড়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠন করে যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে তা দূর করে সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এগিয়ে আসবেন।