আমরা সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীকে দেখাতে চাই আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করেছি। আমরা নিয়ম মানতে শিখেছি। আইনকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি। নিসচা’র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন আজ শনিবার (১১ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম অডিটোরিয়ামে ‘সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা) কেন্দ্রীয় কমিটি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য শাখা যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর আগে যখন এই আন্দোলন শুরু করি তখন অনেকেই আমাকে পাগল বলতো। বলতো, সড়ক দুর্ঘটনায় বউ হারিয়ে লোকটা পাগল হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আমার স্ত্রী ডিসেম্বরে কিন্তু মারা যাননি, তবু ডিসেম্বরকে আমাদের বিজয়ের মাস হিসেবে বেছে নিয়েছি—সড়ক দুর্ঘটনা থেকে আরেকটি বিজয় চাই। মুখের কথা দিয়ে নয়, বাংলাদেশকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করি। তবে যারা শুধু মুখ দিয়েই বলে দেশকে ভালোবাসেন তারা দেশের জন্য কিছু করুন নইলে দেশকে যে ভালোবাসার কথা বলেন তা বিশ্বাস করি না।
দেশে ১২০টি শাখাসহ বিদেশেও দেশের মানুষেরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। আমরা এজন্য গর্বিত। আমরা মনে করি, চালকরাও আমাদেরই, তাদের জন্য কাজ করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না। করোনাকালে চালকদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের শাখাগুলো থেকে করোনায় ঈদের সময় সাধ্যমতো চালকদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছি। প্রতিটা সংগঠন কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করে। কিন্তু আমরা তা মানি না, সেই টাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। তার প্রয়াস হিসেবে ৫০টি পরিবারকে সেলাই মেশিন দিচ্ছি। এর সঙ্গে আমাদের শাখাগুলো আরও পঞ্চাশটি সেলাই মেশিন বিতরণ করবে বলে আমাকে জানিয়েছে। দেশটা আমাদের—চালক, ক্ষতিগ্রস্ত সবাই আমাদের। আমরা তাদের জন্য কাজ করে যেতে চাই। তবে টাস্কফোর্সের যে ১১১টি প্রস্তাবনা রয়েছে আমার আপনার কাছে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সেসবের দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে নিসচা প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর চলে গেছে আর ৫০ বছর পার করতে চাই না এভাবে। আমরা একটা সভ্য জাতি হিসাবে সম্মানিত হতে চাই বিশ্ব দরবারে। আমরা সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীকে দেখাতে চাই আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করেছি। আমরা নিয়ম মানতে শিখেছি। আইনকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহনে হাফ ভাড়ার পাশাপাশি পরিবহন চালক ও শ্রমিকদের সন্তানদের পড়ালেখা অবৈতনিক করা হোক। সেই সঙ্গে বেরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তাদের হাফ বেতনে পড়া লেখা করানোর সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাই।
অনুষ্ঠানে প্রতিবছরের ন্যায় নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ২৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় পরিবারের জন্য কেন্দ্রীয় ও শাখা পর্যায়ে এ ধরনের ১২০টি পরিবারের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ৫০টি পরিবারকে জীবিকা নির্বাহের জন্য সেলাই মেশিন দেওয়া হয়।
নিসচা’র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম, বিআরটিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান ম. আ. হামিদ প্রমুখ।
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা চাই একটি সড়ক দুর্ঘটনাতেও যেন মানুষ না মারা যায়। সরকারও সেভাবে কাজ করছে। কিন্তু মহামারি ক্যান্সার প্রভৃতি রোগে যত সংখ্যক মানুষ মারা যায় তার চেয়েও সড়ক দুর্ঘটনায় বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। ১৫/২০ বছর আগে যদি ফিরে দেখেন ঢাকা-আরিচা সড়ক যেন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছিলো। ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর সেখানে যাতায়াতের সময়য় সে দুর্ঘটনা তেমন দেখি না। মূলত রাস্তা উন্নতকরণের কারণে দুর্ঘটনা কমে এসেছে। তবে শুধুই যে সড়ক বা চালকের জন্য দুর্ঘটনা ঘটে, তাও কিন্তু নয়।
তিনি বলেন, বিদেশে ২০ শতাংশ সড়ক আছে। কিন্তু আমরা নিজেদের দেশে তা ৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে এনেছি। প্রধানমন্ত্রী যাতায়াত নিরবচ্ছিন্ন করতে এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, ব্রিজ প্রভৃতি নির্মাণ করে চলেছেন। জার্মানিতে দেখেছি, আড়াই’শ কিলোমিটার গতিতেও গাড়ি চলেছে। কিন্তু সেটা আমরা চিন্তা করতে পারছি না আমাদের ঘনবসতির জন্য।
মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, আমরা তো আইনভঙ্গকারী জাতিতে পরিণত হয়েছি। হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ হয়েছিলো, মালিকেরা তাদের গাড়িতে সেটি আবার লাগাচ্ছে। এটা কিভাবে হচ্ছে সেটা দেখতে হবে। আইনভঙ্গ করে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছি। এভাবে প্রতিনিয়ত আইন ভাঙছি। তাই এই নিরাপদ সড়কের দাবিতে আমরাও একমত এবং একসঙ্গে কাজ করতে চাই।
দুর্ঘটনা রোধে নিসচার ১১১টি সুপারিশের প্রসঙ্গে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আপনারা ১১১টি সুপারিশ করেছিলেন। সেটি আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে। যোগাযোগমন্ত্রী এটি আমার হাতে দিয়েছেন। এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন ১/২ বছরে করা সম্ভব না। স্বল্প-মধ্যমেয়াদী করে করতে হবে। বাস-ট্রাক বে’র কথা বলা হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া সড়কে এমনটি করা হয়েছে। আমাদের জায়গা কম, ইচ্ছা অনেক বেশি। ধীরে ধীরে চালকদের বিশ্রামাগার রাখার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তাদেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। আবার ড্রাইভারকেও সচেতন হতে হবে। ঢাকাকে স্মার্ট সিটি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তখন পুরো ঢাকা ক্যামেরার অধীনে চলে আসবে। তবে এটাও সময় সাপেক্ষ। এরপর চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহরেও তাই করা হবে। তাই সবশেষে বলতে চাই, আমিও আপনাদের সবার মতো নিরাপদ সড়ক চাই, যেন আর সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটে, কেউ আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।