গত ৫ মে, ২০২৪ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় “মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা, ২০২৪” প্রণয়ন করেছে। জারি করা মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা রোডক্র্যাশ ও প্রতিরোধযোগ্য অকাল মৃত্যু ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছে রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ। একই সাথে এই নির্দেশিকার যথাযথ বাস্তবায়ন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও সেকেন্ড ডিকেইড অব একশন ফর রোড সেফটি অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
বর্তমান সরকার দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখছে। এরপরেও রোডক্র্যাশ বাড়ছে ও একইসঙ্গে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। দেশের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। পাশাপাশি মোটর সাইকেলের অনিয়ন্ত্রিত গতি প্রতিনিয়ত দেশের কর্মক্ষম তরুণসহ অনেকের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এমতাবস্থায়, রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতারভিত্তিতে বাংলাদেশের সড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি নির্দেশনার দাবি করে আসছিল। মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা জারি করায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছে রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ।
এই নির্দেশিকায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলোঃ
১. সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা, ২০২২ এ গতিসীমার কথা উল্লেখ থাকলেও এই নির্দেশিকার মাধ্যমে দেশের জন্য প্রথমবারের মতো প্রতিটি সড়কে মোটরযানের সরব্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারিত হলো।
বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণ করায় রোডক্র্যাশ কমবে। এতে মানুষের জীবন বাঁচবে ও পঙ্গুত্ব হওয়া/ হওয়ার হার কমবে, হাসপাতালগুলোতে রোডক্র্যাশ রোগীর সংখ্যাও কমে আসবে। কমগতি সম্পন্ন মোটরযানের চালকের পক্ষে সামনে সড়কের ঝঁুকিপূর্ণ ব্যবহারকারীদেরকে সহজে দেখতে পারবেন এবং এতে তিনি তার মোটরযানের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। ফলে রোডক্র্যাশের সংখ্যা যেমন কমবে সেইসাথে হতাহতের সংখ্যাও কমবে।
২. এর পর আসা যাক এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইওয়ে (মহাসড়ক)কে সরব্বোচ গতিসীমা ৮০ কি:মি:/ঘণ্টা নির্ধারিত করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে সর্ব্বোচ গতিসীমা ৮০ কি:মি:/ঘণ্টা করায় রোডক্র্যাশের সংখ্যা এবং প্রাণহানির ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। কম গতি রোডক্র্যাশ হওয়ার সম্ভবনা কমায়, সবার জন্য সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। বাংলাদেশের সড়কের অবকাঠামো ও ডিজাইন ৮০ কি:মি:/ ঘণ্টা অধিক গতিসীমা নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত নয়। যেহেতু এক্সপ্রেসওয়ে ও মহাসড়কে যথাযথ এক্সেস কন্ট্রোল নেই সেহেতু যানবাহনের ধরন অনুযায়ী গাড়ির যে গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক। আমরা আরও জানাতে চাই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সপ্রেসওয়ে ও মহাসড়কে ৮০ কি: মি:/ঘণ্টা গতিসীমা নির্ধারিত করে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সক্ষম হয়েছে।
৩. বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা এবং হাট—/হাট —বাজার সংলগ্ন সড়ক বা মহাসড়কে মোটরযানের সর্বোচ্চ গতিসীমা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বা রাস্তা নির্মাণকারী বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত হবে; অর্থ্যাৎ আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের (বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা এবং হাট—/ হাট —বাজার সংলগ্ন প্রতিষ্ঠানের) উপর দায়িত্ব অর্পণ করার কারণে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন অনুসারে সর্বোচ্চ গতিসীমা মাথায় রেখে নির্ধারণ করতে পারবে।
৪. শহর এলাকার জন্য এই প্রথম গতিসীমা নির্ধারিত হলো। অথার্ৎ শহর এলাকাকে গুরুত্ব দিয়ে গতিসীমা নির্ধারণ করা, যা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের অনেক দেশের শহর এলাকায় নির্দিষ্ট গতিসীমা নির্ধারিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে রোড সেইটি/ সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশের বক্তব্য হচ্ছে, ঘনবসতি সম্পন্ন গ্রামাঞ্চল ও শহরের জন্য মোটরসাইকেলের গতিসীমা নির্ধারণ করায় সড়কে চলাচলের জন্য শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা উপকৃত হবেন। বিশ্বের অনেক দেশ শহরাঞ্চলের রাস্তায় সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কম গতিসীমা নির্ধারণ করেছে।
৫. মোটর সাইকেলের জন্য সিটি কর্পোরেশন/ পৌরসভা/ জেলা সদরের মধ্য দিয়ে ব্যবহৃত জাতীয় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক; সিটি কর্রোপরেশন/ পৌরসভা/ জেলা সদরের অভ্যন্তরীণ সড়ক, উপজেলা সড়ক; শহর এলাকায় প্রাইমারী আরবান, গ্রামীণ সড়কে ৩০ কি:মি:/ ঘণ্টা ও শহর এলাকায় সংকীর্ণ / শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়কে ২০ কি:মি:/ ঘণ্টা করা হয়েছে। সড়কে/ মোটরসাইকেলের গতি কমালে সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারকারী (পথচারী, সাইকেল আরোহী ও মোটরসাইকেল আরোহী) সাথে রোডক্র্যাশের কারণে প্রাণহানী ও গুরুত্বর আঘাতের সম্ভাবনা উল্লেখ্যযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব। কারণ মোটরসাইকেলের গতি কম হলে রোডক্র্যাশ ঘটার মধ্যে কিছু সময় পাবার কারণে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি সম্পন্ন দেশে মোটরযান ও সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারকারী ( যেমন: পথচারী, বাইসাইকেল ব্যবহারকারী, মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী) উভয়ই সুরক্ষিত থাকবে। এছাড়াও গতি কম থাকার ফলে মোটরসাইকেলের কন্ট্রোলিং—এ বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে, যা অপ্রত্যাশিক রোডক্র্যাশ এড়াতে সহায়তা করবে।
বিশ্বের অনেক দেশ শহরাঞ্চলে সড়ক নিরাপত্তার জন্য মোটরসাইকেলের গতির সীমা কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশেও অনুরূপভাবে গতি সীমা বাস্তবায়ন করলে রোডক্র্যাশ ও প্রাণহানি কমানো সম্ভব হবে।
৬. পাহাড়ি এলাকার জন্য এই প্রথম নিদিরষ্ট গতিসীমা নির্ধারিত হলো। পাহাড়ি সড়কের গতিসীমা আগে কোনো আইনে উল্লেখ ছিল না।
এছাড়াও গ্রামাঞ্চল ও শহরের ঘনত্বের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এই নির্দেশিকায়। রাস্তার ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন মোটরযানের গতি ভিন্ন ভিন্ন করা হয়েছে, যা সড়ক নিরাপত্তার জন্য মানসম্মত বিষয় বলে মনে করে রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ। তবে এক্ষেত্রে লেন ভিন্ন করলে নির্দেশিকাটির বাস্তবায়ন সহজতর হবে। রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ আশা করে যে, সরকার এ ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
কোয়ালিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এই নির্দেশিকাটি বাস্তবায়ন করা গেলে পরিবেশের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমে আসবে, প্রতিরোধযোগ্য রোডক্র্যাশ এবং সড়কে অকাল মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ব্যক্তি ও সরকারের চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস পাবে তথা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এই নির্দেশিকা বাস্তবায়ন করলে সড়কে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ঝুঁকিপূর্ণ পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
আবারও বর্তমানে এই নির্দেশিকা জারি করায় সরকারকে অভিনন্দন জানাই। পাশাপাশি এটি অবিলম্বে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নিন্মলিখিত সুপারিশগুলোর উপর দৃষ্টি আর্কষণ করছিঃ
১. অতিসত্তর “মোটরযানের গতিসীম নির্দেশিকা, ২০২৪” সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, বিভাগে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা ও পদক্ষেপ গ্রহণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা
২. এই নির্দেশিকাতে যেসব বিষয় (যেমন: কিভাবে বিভিন্ন গতির মোরটযানগুলো ওভারটেক করবে; লেন পরবর্তন কিভাবে হবে; সড়কে কবে থেকে নির্দেশিকা কিভাবে, কখন ও কোথায় প্রয়োগ হবে) তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা প্রদান করা
৩. নিয়মিতভাবে মনিটরিং এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রতিমাসে একটি সমন্বয় সভার মাধ্যমে রোডক্র্যাশের সংখ্যা ও কারণ বিশ্লেষণ করে তথ্য প্রদান করার দাবি জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য “গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি—২০২৩” তে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০২১ (১০ বছরে) ১০টি দেশ (বেলারুশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়ান ফেডারেশন, ত্রিনিদাদ, টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনিজুয়েলা) রোডক্র্যাশে মৃত্যু হার ৫০% কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই ধরনের সেফ সিস্টেম এপ্রোচ এর বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে নিরাপদ সড়ক কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণে ও নিশ্চিতকরণে রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে প্রস্তুত আছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান সরকার দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি সড়কে দুর্ঘটনা এবং সড়কে অকাল মৃত্যু কমিয়ে আনতে মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকাও প্রণয়ন করেছে। আমরা মনে করি এই নির্দেশিকাটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে সড়কে দুর্ঘটনা এবং সড়কে অকাল মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বিশেষভাবে বলতে চাই এই নির্দেশিকা বাস্তবায়ন করলে সড়কে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ঝুঁকিপূর্ণ পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
এখানে আরও বলতে চাই সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালায় যানবাহন ও পরিবহন সেক্টরই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অনেকটা অনুপুস্থিত। তবে সরকার যেহেতু সড়কের নিরাপত্তার ব্যাপারে আন্তরিক। যে কারণে এই গতি নির্দেশিকা শুধু প্রণয়নই নয়, সড়কে যানমালের নিরাপত্তার জন্য নির্দেশিকাটি বাস্তবায়নও করবে সরকার। তাই আমরা দাবি জানাতে চাই সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকার দ্রুত একটি সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে জরুরিভাবে পদক্ষেপ নিবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন কোয়ালিশনের সদস্য যথা ব্রাক, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সিআইপিআরবি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, অর্থোপেডিক সোসাইটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বিএনএনআরসি, স্টেপ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউণ্ডেশন—এর প্রতিনিধিবৃন্দ।
৮০কিলো মিটার এর উপরে যেন গাড়ি না চালাতে পারে সে জন্য স্পীডগর্ভনর সিল করা হতো কিন্তু তা এখন আর করা হয়না বিধায় সড়কে এতো দূর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।