২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৯৬৯ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন। এ সময় মোট ৪০৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বুধবার (৬ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে সড়ক দুর্ঘটনার এ পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
এসময় জানানো হয়, ২০২০ সালে রেলপথের দুর্ঘটনায় ১২৯ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হন আর নৌপথের দুর্ঘটনায় ২১২ জন নিহত ও ১০০ জন আহত বা নিখোঁজ হন।
নিসচার প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে, গত বছরের জানুয়ারি মাসে বেশি ৪৪৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৪৯৫ জন নিহত ও ৮২৩ জন আহত হন। আর এপ্রিল ও মে মাসে সবচেয়ে কম যথাক্রমে ১৩২ ও ১৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশে লকডাউন থাকায় দুর্ঘটনা কম হয়েছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন লিখিত বক্তব্যে জানান- ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এলাকায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) এলাকায় কম দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি দাবি করেন, এসব এলাকায় চালকরা তুলনামূলক কম গতিতে নিয়ন্ত্রণে রেখে যানবাহন চালানোর কারণে দুর্ঘটনা কম হয়েছে।
আর সড়ক দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন- সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল এবং রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট থাকা।
সড়ক আইনের সঠিক বাস্তবায়ন হলে সড়ক নিরাপদ হয়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নিসচা কেন্দ্রীয় কমিটির আয়োজনে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য পাঠ করেন নিসচার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন, যুগ্ম মহাসচিব লিটন এরশাদ। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মিরাজুল মইন জয়, স্বাগত বক্তব্য রাখেন, মহাসচিব সৈয়দ এহসান -উল হক কামাল, শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আজাদ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, যুগ্ম মহাসচিব সাদেক হোসেন বাবুল, অর্থ সম্পাদক আসাদুর রহমান,সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রহমান, নির্বাহী সদস্য এম নাহিদ মিয়া, লায়ন গনি মিয়া বাবুল, কামাল হােসেন খান, নাইমুল খান প্রমুখ ।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কর্তৃক ২০২০ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থাপন এর পাঠ করা বক্তব্যটির আংশিক অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলো।
সুপ্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা
নিরাপদ সড়ক চাই এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। সম্মেলনের শুরুতেই নিসচা পরিবারের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত জাহানারা কাঞ্চনসহ সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।২০১২ সাল থেকে আমাদের সংগঠন প্রতিবছরই সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন জাতির সামনে উপস্থাপন করে আসছে। ইতোমধ্যে ২০২০ সালের প্রতিবেদন আমরা তৈরি করেছি যা প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত আজকের এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সকল ইলেকট্রনিক মিডিয়া, দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থা সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ সকলকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
দেশের সড়ক দুর্ঘটনা গতবছর ২০২০ সালে বিগত দুই বছরের তুলনায় তুলনামূলক কম হয়েছে। গত বছরগুলোর তুলনায় এটাকে কম বলা যায় না এ কারণে যে, ২০২০ সালটি করোনা মহামারীর বছর।জরুরি যানবাহন ছাড়া অন্যান্য যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল।যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা আরো কম হওয়া উচিত ছিল কারণ গত এপ্রিল এবং মে ২০২০ ব্যতীত অন্যান্য মাসগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা বিগত বছরগুলোর মতই হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নিম্নোক্ত কারণগুলো উঠে এসেছে
- সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং এর অভাব
- টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া
- চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা
- দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা করা
- লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ
- পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব
- ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা
- বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালনা
- ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালনা বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা
- সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি
- মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি
- একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও স্লথ যানবাহন চলাচল
- রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট
এছাড়াও অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়ন না হওয়া ইত্যাদিই মূল কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়। এসব মূল কারণ চিহ্নিত করে ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর আমার সহধর্মিনী জাহানারা কাঞ্চন-এর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর শোককে শক্তিতে পরিণত করে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন আমার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে যার নাম ‘’নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’’।এই সংগঠনের কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে দেশ ও বিদেশের ১২০টি শাখা-সংগঠন সক্রিয়ভাবে জনসচেতনতাসহ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে প্রতি বছর আমরা সড়ক দুর্ঘটনা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকি। আশা করি আপনাদের মাধ্যমে ২০২০ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ও প্রতিবেদন দেশের জনগণ জানতে পারবেন এবং আপনারা এর ভয়াবহতা নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন। পাশাপাশি নিজেরা সচেতন হবেন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
২০২০ সালের উল্লেখযোগ্য বড় দুর্ঘটনাসমূহ
সড়ক পথ
১) ১লা মার্চ ২০২০ রাজশাহীর গোদাগারিতে মাইক্রোবাস উল্টে ০৮ জনের মৃত্যু।
২) ৭ই মার্চ হবিগঞ্জের নবিগঞ্জে মাইক্রোবাস উল্টে ১২ জনের মৃত্যু।
৩) ২২মার্চ চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় ট্রাক-হিউম্যান হলারের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু।
৪) ২২ মে গাইবান্ধার পলাশবারিতে ট্রাক খাদে পড়ে ১৫ জনের মৃত্যু।
রেলপথ
১) ১৭ অক্টোবর ২০২০ যশোরের অভয়নগরে কার ও ট্রেনের ধাক্কায় ০৪ জনের মৃত্যু।
২) ২০ ডিসেম্বর ২০২০ জয়পুরহাটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং-এ বাস ও ট্রেনের সংঘর্ষে ১২ জন নিহত।
নৌপথ
১) ২৯ জুন ২০২০ ঢাকার বুড়িগঙ্গায় লঞ্চের ধাক্কায় ৩৪ জনের মৃত্যু।
২) ৫ আগস্ট ২০২০ নেত্রকোনার মদনে নৌকা ও ট্রলারের সংঘর্ষে ১৮ জনের মৃত্যু।
৩) ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ নেত্রকোনার কলমাকান্দিতে ট্রলার ডুবে ১২ জনের মৃত্যু।
মোট নিহত সংখ্যার ২৫% চালক ও পরিবহন শ্রমিক
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর সর্বশেষ (সেপ্টেম্বর২০২০) তথ্য মোতাবেক দেশে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০টি।এর মধ্যে বাস ৫১ হাজার ৬৬৮টি, ট্রাক ১লাখ ৫৫ জাহার ৭৭৬টি, কাভার্ড ভ্যান ৩৫ হাজার ৩১১টি, মাইক্রোবাস ১ লাখ ৬হাজার ২৮২টি, অটো রিক্সা ৩ লাখ ১২ হাজার ৫৮১টি, মোটর সাইকেল ৩০ লক্ষ্য ৩২ হাজার ৫৫৯ টি, মিনিবাস ২৯ হাজার ৫৪৬ টি, পিকআপ ১ লাখ ৩৩হাজার ৭৯টি, ট্যাক্সি ক্যাপ ৪৫ হাজার ৭৭৯টি, ট্রাক্টর ৪৭ হাজার ১৫৯টি, ব্যক্তিগত কার ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৫০টি, স্পেশাল পারপাস গাড়ি ১২ হাজার ২১৮টি। ট্যাংকার ৬ হাজার ১০টি, জীপ ৬৬ হাহার ৯৪৯টি, কার্গো ভ্যান ৯ হাজার ৭০৩টি, এ্যাম্বুলেন্স ৬ হাজার ৭৯২টি। অটো ট্যাম্পু ২০ হাজার ৮৫০টি। ডেলিভারী ভ্যান ৩১ হাজার ৫২৮টি, হিউম্যান হলার ১৯ হাজার ৫৩টি, অন্যান্য ২৮ হাজার ৮০৭টি। এর বাইরে অনিবন্ধিত নসিমন/করিমন/ভটভটি/ব্যাটারি চালিত রিক্সা/অটো সহ কয়েক লক্ষ্য যানবাহন দিব্যি চলাচল করছে। বিআরটিএ –এর তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরযান রয়েছে ৪৫ লাখের ও বেশী। এর মধ্যে প্রায় ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্স বিহীন চালক পরিবহন খাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারাদেশ। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ অদক্ষ চালক বাস,ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানসহ ভারী যানবাহন চালাচ্ছে বলে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ(বিআরটিএ) সুত্রে জানা গেছে। এছাড়া মোটর সাইকেলের অধিকাংশ লাইসেন্স নেই।
মন্তব্যঃ
১. আনুমানিক ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) অটো-টেম্পো/অটো-রিকশার মেয়াদ উত্তীর্ণ ও টু স্টোক হওয়ার কারণে সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে ১৩,০০০ (তেরো হাজার) ফোর-স্টোক সিএনজি যুক্ত হয়েছে।
২. মেয়াদউত্তীর্ণ হওয়ার কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মোটরসাইকেলকে সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
৩. মেয়াদউত্তীর্ণ হওয়ার কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভারী/মধ্যম/হালকা যানবাহকে সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বিআরটিএ কর্তৃক সরবরাহকৃত উপরোক্ত রিপোর্টে দেখা যায় বাংলাদেশে বাসের সংখ্যাও ৫১,৬৬৮। এর মধ্যে ৬৯৮টি বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এবং ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও পিক-আপ মিলে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে ১৪৭৭টি। লকডাউন এর সময় বাস বন্ধ থাকলেও রাস্তা ফাঁকা পেয়ে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান এবং পিক-আপ মিলে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। বাকি ৪১ লক্ষ্য ৪৭ হাজার ৮৬৬টি যানবাহনে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ১৬৪৭টি। একই হারে যদি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতো অথবা বাস ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপের সংখ্যা যদি আরো বেশি হতো তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কত গিয়ে দাঁড়াত এবং ক্ষতির পরিমাণ যে কি হত এ বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
মোটরসাইকেল আরোহী
২০২০ সালের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সংখ্যা ১১২৭টি।গত ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১৯% থাকলেও তা বেড়ে ২৭% দাঁড়িয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ৮% বেশি। ঢাকা মেট্রোপলিটনসহ অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরে মোটরসাইকেল চালকদের হেলমেট পরিধানেরর সু-অভ্যাস গড়ে ওঠা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও অন্যান্য জেলা ও গ্রাম গঞ্জে হেলমেট না পরার প্রবণতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাথে সাথে অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের মোটরসাইকেল চালনায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও প্রশাসনের সামনে দিয়ে লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল ও অপ্রাপ্ত বয়সের কিশোরেরা মোটরসাইকেল চালনা করে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের কর্মীবৃন্দ নিয়মকানুন না মেনে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এবং তাদের দেখাদেখি অন্যরাও উৎসাহিত হয়। বিআরটিএ তথ্য অনুযায়ী দেশে রেজিস্ট্রেশনকৃত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩০ লক্ষ ৩২ হাজার ৫৫৯টি এবং লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ১৭ লক্ষ ৫৩ হাজার ৮০০জন। এতে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বিআরটিএ তথ্য অনুযায়ী ১২ লক্ষ ৭৯ হাজার ১৭৯ জন মোটরসাইকেল চালক আইন শৃঙ্খলা বাহিনির নাকের ডগা দিয়ে অবৈধভাবে মোটর সাইকেল চালনা করছে আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিআরটিএ নির্ভীকচিত্তে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে যেন তাদের কিছুই করার নেই। এভাবে চলতে থাকলে মোটরসাইকেল চালকদের দ্বারা সড়ক দুর্ঘটনা কমবে না বাড়বে আপনাদের কাছেই প্রশ্ন রাখলাম? আঞ্চলিক ও গ্রামীণ এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার জন্য আরোহীদের হেলমেট না পরার প্রবণতা, ২ (দুই) এর অধিক আরোহী, বেপরোয়া গতিতে মোটর সাইকেল চালানো ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলাতে দায়ী করা হয়েছে। এ সমস্ত এলাকায় যদি মেট্রোপলিটন শহরগুলোর মতো একইভাবে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো তাহলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও মৃতের হার আরও কমানো যেত। মোটরসাইকেল চালকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, ট্রাফিক আইন কানুন সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা প্রদান, দেশের অল্প বয়স্ক যুবসমাজ মোটর সাইকেল চালনায় বিধিনিষেধ আরোপ ও গতির ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ও মৃতের সংখ্যা কমানো সম্ভব। মোটরসাইকেল বিক্রয়ের পূর্বে অভিভাবকদের উচিত উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্স প্রাপ্তির পর মোটরসাইকেল চালনা করতে দেওয়া। সেই সাথে বিক্রেতার উচিত লাইসেন্স ছড়া মোটরসাইকেল বিক্রয় না করা এবং বিআরটিএ এর মাধ্যমে অরিয়েন্টেশন কোর্স প্রদানপূর্বক গাড়ি চালনার নিয়ম কানুন শিখে লাইসেন্স প্রদান নিশ্চিত করে গাড়ি বিক্রয় করা।
২০২০ সালে সংঘটিত দুর্ঘটনার ধরণ
ধরণ | দুর্ঘটনা | নিহত | আহত |
চাপায় | ১৮৯০ | ২০৯০ | ১০০৯ |
পেছন থেকে ধাক্কা | ৬০ | ৮৬ | ১০০ |
মুখোমুখি সংঘর্ষ | ৬৯৮ | ৯৬২ | ১৮২১ |
উল্টে গিয়ে | ৪৬৫ | ৫৩০ | ১০৪৫ |
খাদে পড়ে | ৮৫ | ১৩৯ | ৮৬৬ |
ওড়না পেঁচিয়ে | ০৮ | ০৮ | ০০ |
অন্যান্য | ২০৪ | ৩২৬ | ২৪৪ |
উপরোক্ত দুর্ঘটনার ধরণ থেকে লক্ষ্য করা যায় যে, ট্রাফিক আইন না মেনে ওভারটেকিং এর প্রবনতা এবং হাইওয়ে তে বামদিক দিয়ে ওভার টেকিং করার প্রবনতাই মুখোমুখি সংঘর্ষের প্রধাণ কারণ হিসেবে দেখা যায়। ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১০৪৬ জন পথচারী মারা গিয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ২১%। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে পথচারীরা গাড়ি চাপায়, পেছন দিকথেকে ধাক্কাসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পথচারীদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কিত ধারণা না থাকা, রাস্তা চলাচল ও পারাপারে মোবাইল ফোন ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিং,আন্ডারপাস,ফুটভার ব্রীজ ব্যবহার না করে যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের ফলে সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে।
২০২০ সালে মাসওয়ারী দুর্ঘটনার হিসাব
মাস | দুর্ঘটনা | নিহত সংখ্যা | আহত সংখ্যা |
জানুয়ারি | ৪৪৭ | ৪৯৫ | ৮২৩ |
ফেব্রুয়ারি | ৩৬৫ | ৪৩৭ | ৭৬২ |
মার্চ | ৩৭৯ | ৪৫৪ | ৭৬৭ |
এপ্রিল | ১৩২ | ১৩০ | ১২০ |
মে | ১৯৬ | ২৪২ | ২০৬ |
জুন | ২৬০ | ৩৩০ | ২৩৩ |
জুলাই | ২২০ | ২৮৪ | ১৯৭ |
আগস্ট | ৩৪০ | ৪৮৩ | ৪২৩ |
সেপ্টেম্বর | ২১৬ | ২৫০ | ৪০৪ |
অক্টোবর | ২৩০ | ২৬২ | ৩৮৭ |
নভেম্বর | ২৬২ | ৩১৬ | ৩৭২ |
ডিসেম্বর | ৩৬৩ | ৪৫৮ | ৩৯১ |
মোট | ৩৪১০ | ৪১৪১ | ৫০৮৫ |
অপ্রকাশিত তথ্য ও হাসপাতালে ভর্তির পর এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজের পর মৃত্যু ( আনুমানিক (২০%)
| ৬৮২ | ৮২৮ | – |
সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২০ সালের সর্বমোট নিহতের সংখ্যা | ৪০৯২ | ৪৯৬৯ | ৫০৮৫ |
২০২০ সালের জেলা ভিত্তিক দুর্ঘটনার তথ্য
জেলা | দুর্ঘটনার সংখ্যা | নিহত | আহত |
ঢাকা | ২৩৭ | ২৬৭ | ৪৩৭ |
চট্টগ্রাম | ১৬১ | ১৯৩ | ২৫৯ |
গাজীপুর | ১০৩ | ১২৯ | ৭৮ |
ময়মনসিংহ | ১৫২ | ২০৭ | ২০৯ |
বগুড়া | ১১৩ | ১৩৭ | ১১৪ |
দিনাজপুর | ৭৭ | ৯৯ | ৭৩ |
কুমিল্লা | ৮৯ | ১১১ | ১৪৭ |
নারায়ণগঞ্জ | ৬৫ | ৭৫ | ১৭ |
ফরিদপুর | ৬৩ | ৭৯ | ৪৮ |
রাজশাহী | ৮২ | ১০৯ | ৬৯ |
টাঙ্গাইল | ১০১ | ১৬১ | ১৫৯ |
বরিশাল | ১০৪ | ৯৩ | ২৩৮ |
ভোলা | ৩৯ | ৪৫ | ৭৩ |
ঝালকাঠি | ২০ | ১৮ | ৬০ |
পটুয়াখালী | ৪২ | ৪৩ | ৪৬ |
পিরোজপুর | ২০ | ২২ | ০৯ |
বরগুনা | ১৯ | ২২ | ৩১ |
বান্দরবান | ০৭ | ০৯ | ০৭ |
ব্রাহ্মণবাড়িয়া | ৬৬ | ৮১ | ১৭০ |
চাঁদপুর | ৪৭ | ৪৭ | ৬০ |
কক্সবাজার | ৪৬ | ৬৮ | ২১৪ |
ফেনী | ২৬ | ৩৪ | ৫৬ |
খাগড়াছড়ি | ১১ | ১২ | ১৪ |
লক্ষ্মীপুর | ৩৭ | ৪৭ | ৩৯ |
নোয়াখালী | ৩৬ | ৪১ | ৩৩ |
রাঙ্গামাটি | ১৪ | ১২ | ১২০ |
গোপালগঞ্জ | ৭০ | ৮৯ | ২১৬ |
কিশোরগঞ্জ | ৫৩ | ৬১ | ৫৫ |
মাদারীপুর | ৪৮ | ৬১ | ৮৫ |
মানিকগঞ্জ | ৪১ | ৫৫ | ৩১ |
মুন্সীগঞ্জ | ৩০ | ৩৫ | ১৪৬ |
নরসিংদী | ২৩ | ২৭ | ৮১ |
রাজবাড়ী | ২৯ | ৩৯ | ২৩ |
শরীয়তপুর | ১৪ | ১৬ | ০৭ |
বাগেরহাট | ৩৫ | ৪৪ | ৩৭ |
চুয়াডাঙ্গা | ৪২ | ৪৯ | ২৬ |
যশোর | ৫৮ | ৭৪ | ৯২ |
ঝিনাইদহ | ৫৯ | ৬২ | ৬৫ |
খুলনা | ৩৫ | ৪৫ | ২৬ |
কুষ্টিয়া | ৪৪ | ৫৬ | ৯৩ |
মাগুরা | ৩২ | ৩৯ | ৪৭ |
মেহেরপুর | ৩৫ | ৩৫ | ১৫ |
নড়াইল | ১৯ | ১৭ | ২০ |
সাতক্ষিরা | ৩৩ | ৩৭ | ২০ |
জামালপুর | ৩৭ | ৪০ | ১৩ |
নেত্রকোনা | ৬০ | ৬৭ | ৭৩ |
শেরপুর | ৩৩ | ৩৪ | ৬৭ |
জয়পুরহাট | ৪১ | ৫৫ | ৭২ |
নওগাঁ | ৬৪ | ৬২ | ৩৮ |
নাটোর | ৮০ | ৮৭ | ১১১ |
চাঁপাইনবাবগঞ্জ | ৪২ | ৬০ | ১২ |
পাবনা | ৫৪ | ৬০ | ২৬ |
সিরাজগঞ্জ | ৭০ | ৯২ | ১২২ |
গাইবান্ধা | ৫২ | ৬৭ | ৫৯ |
কুড়িগ্রাম | ৩৪ | ৩৯ | ৩৮ |
লালমনিরহাট | ২৬ | ২৮ | ২৪ |
নীলফামারী | ৩৬ | ৪৭ | ২২ |
পঞ্চগড় | ৩৫ | ৩৮ | ২০ |
রংপুর | ৫৯ | ৮৬ | ৯৯ |
ঠাকুরগাঁও | ২৩ | ২৭ | ২৬ |
হবিগঞ্জ | ৭৬ | ১১৪ | ২১৫ |
মৌলভীবাজার | ৪৩ | ৪৪ | ৫৫ |
সুনামগঞ্জ | ২১ | ২৩ | ৬৪ |
সিলেট | ৪৭ | ৬৯ | ৬৪ |
মোট |
জেলা ভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্লেষণ
জেলাভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ দেখা যায় যে ২০২০ সালে ঢাকা ও তার আশেপাশের ২৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩৬৭, চট্টগ্রামে ১৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সংখ্যা ১৯৩, ময়মনসিংহে ১৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২০৭, গাজীপুরে ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১২৯জন। অতিরিক্ত লোক সংখ্যা, অপর্যাপ্ত রাস্তা, মোটরসাইকেল ও রিক্সার আলাদা লেন না থাকা, শহরের মধ্যে পোশাক কারখানা এবং পথচারীদের নিয়ম না মানার প্রবণতাকে দায়ী করা হয়ে থাকে। প্রায়শই দেখা যায় জেব্রাক্রসিং, ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস থাকা সত্ত্বেও এগুলো দিয়ে পারাপার না হয়ে যত্রতত্র পারাপার, রাস্তায় চলা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহারের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়াও একটি কারণ বলে উল্লেখিত আছে। এছাড়াও বড় বড় শহরগুলোতে উল্টো পথে চলাচল একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যদিও ঢাকা শহরে সরকারি আমলাদেররা নিয়মমাফিক চলাফেরা করে কিন্তু অন্যান্য গাড়িসমূহ উল্টো পথে যাতায়াতের প্রবণতা এখনও লক্ষ্য করা যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মাঝে মাঝে উল্টোপথে চলার প্রবণতাকে থামানোর জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগের অভাবে তা কার্যকরী হয় না। পাশাপাশি খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় দুর্ঘটনার সংখ্যা সব থেকে কম লক্ষণীয়। কারণ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও আঁকাবাঁকা রাস্তা হওয়ার কারণে গাড়ি অত্যন্ত সাবধানে চলাচল করায় দুর্ঘটনা কম হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে সাবধানে গাড়ি চালালে সড়ক দুর্ঘটনা কম ঘটে।
দুর্ঘটনার সংখ্যা
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৪০৯২ টি। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬১০টি কম। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৩৭২৩টি। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৯৭৯টিবেশী। কিন্তু এবারে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের সড়ক দুর্ঘটনা তুলনামূলক কম লক্ষণীয় যা ২০১৯ সালের দুর্ঘটনার অনুপাত থেকে ১৫% কম। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি আকারে দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশেও এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে অফিস-আদালত, দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধ থাকে। মূলত ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনা এ কারণে কম হয়েছে তবে তা আশাব্যঞ্জক না। আমরা মনে করি নিরাপদ সড়ক চাই এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও যদি একই উদ্যোগ গ্রহণ করা হতো বিশেষ করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর করা হতো তাহলে দুর্ঘটনা এ বছর আরো কমানো সম্ভব হত। সড়ক দুর্ঘটনায় এ প্রতিবেদনটি ১১টি জাতীয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ, দি ডেইলি স্টার, সময়ের আলো, বাংলাদেশের আলো, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের নতুন সময়, ও ডেইলি আওয়ার টাইম পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্ক্রোল, অনলাইন নিউজ ও শাখা সমূহের দুর্ঘটনা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদকদের প্রেরিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও আরও অনেক আঞ্চলিক তথ্য অপ্রকাশিত হয়েছে যা কোন মিডিয়ায় উঠে আসেনি। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রকৃত সংখ্যা সঠিক ও নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটি করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। ইতোপূর্বে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ, সিভিল সারজেন ও জেলা প্রশাসন থেকে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের নিয়মিত কোন তথ্য প্রদান না করার কারণে সরকারিভাবে কোন পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় না। প্রতিবারের মতো এবারেও আমরা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি দুর্ঘটনা অনুসন্ধান সেল গঠনপূর্বক প্রতিবছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য জাতির কাছে উপস্থাপন করার অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে করে সঠিক ও নিখুঁত সড়ক দুর্ঘটনাযর তথ্যাদি সকলে জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
নিহতের সংখ্যা
২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪৯৬৯। ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ছিলো ৫২২৭। গত বছরের তুলনায় এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৬১০ জন কম।২০১৮ সালে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৪৩৯। ২০১৮8 সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার প্রায় ১৬%বেশি ছিল। গত বছর ২০২০ সালের ২০১৯9 সালের তুলনায় শতকরা ১৮% দুর্ঘটনা কম হয়েছে।
আহতদের সংখ্যাঃ
২০২০ সালে মোট ৪০৯২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০৮৫ জন লোক আহত হয়েছে। ২০১৯ সালে ৪৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল ৬৯৫৩ জন, এ বছর আহতের সংখ্যা ১৮৬৮ জন কম। গত বছরের তুলনায় আহতের সংখ্যা এবার প্রায় ২৪ শতাংশ কম বলে রপর্িোটে পাওয়া যায়। অনেক ছোট ছোট দুর্ঘটনায় আহতদেরকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করা হয় পত্রিকায়ও প্রকাশ হয় না। এদের মধ্যে অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে। যা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি।
সুপ্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরাঃ
২০২০ সালে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে বড় বড় শহর ও হাইওয়েতে। এছাড়াও অবৈধ যানবাহন যেমন- ভ্যান, রিক্সা, নসিমন, অটো রিক্সা ইত্যাদিকেও এজন্য বেশী দায়ী বলে প্রতিয়মান হয়। আইনকে অমান্য করে ধীর গতির বাহন মহাসড়কে এখনো চলাচল করে যা দূরপাল্লার বড় গাড়ীগুলোর চলাচলে বিঘœতার সৃষ্টি করে। স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশকে এ ব্যাপারে তেমন কোন কার্যকর ভুমিকা পালন করতে দেখা যায় না। অবৈধ যানবাহনের চলাচলে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতাও আছে বলে প্রতিয়মান হয়। তাছাড়াও এ সমস্ত ধীর গতির গাড়ীর হেডলাইট ও ব্রকে না থাকার কারণে ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টিতে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। যেখানে ঘন কুয়াশায় লঞ্চ, স্টীমার, নৌকা এমনকি উড়োজাহাজ চলাচলকেও বন্ধ করে দেয়া হয় সেখানে কুয়াশায় গাড়ী চালনার জন্য নির্দিষ্ট গতি নির্ধারণ করা সত্বেও তা মানা হয় না
যা ইতিপূর্বেও বহুবার বলা হয়েছে তবুও চালক, মালিক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। ২০২০ সালে বাস, ট্রাক ও কাভার্ড- ভ্যান মিলিয়ে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে যা সড়ক দুর্ঘটনার ৪০%। এছাড়াও মটরসাইকেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা শতকরা ২৬%। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এটাও একটি বড় কারণ| তাছাড়া সড়ক পরিবহণ আইন ২১০৮ এখনও পুরোপুরি কার্যকরী না হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ভূমিকা রাখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আরো সোচ্চার হওয়া ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত বলে আমরা মনে করি
সুপারিশমালাঃ
- সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জরুরি কার্যক্রম গ্রহন করাঃ
- মাননীয় প্রধান মন্ত্রী কর্তৃক নির্দেশিত ৬ দফা নির্দেশনামা দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
- টাস্ক ফোর্স কর্তৃক দাখিলকৃত ১১১ টি সুপারিশনামা যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা।
এ আইনটি নিয়ে কিছু কুচক্রী মহল জনসাধারণ ও চালকদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করছে। আসলে এই আইনটি কোনো জেল,জরিমানার জন্য নয়, এই আইনটি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য করা হয়েছে। সকলেই যদি আইনটি মেনে চলে তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আসবে যেখানে জেল-জরিমানার কথাই আসেনা।বিশেষ করে এ আইনটি যে চালকবান্ধব (যেমন আইনটিতে চালকদের নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা কল্যাণ তহবিল, পোশাক) ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে তা বিভিন্ন লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা যাতে করে চালকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়। সুতরাং এই আইনকে মানার প্রবণতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- হাইওয়েতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ তত্বাবধানে উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং সেল গঠন করে তাদের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মহাসড়কের যাবতীয় বিষয়সমূহ মনিটরিং করতে হবে।
- করোনা নিয়ে সরকারিভাবে যেরকম প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।
- বিভিন্ন মিডিয়া মাধ্যমে সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান প্রচারের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনারোধের বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্ত করার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। - ঢাকা রুট ফ্রান্সাইজ এর যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
- ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্র-তত্র গাড়ী পার্কিং করা, নির্দিষ্ট স্থান ব্যাতিরেকে যেখানে-সেখানে যাত্রি উঠানো-নামানো, ওভার টেকিং করা, পাল্টা-পাল্টি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা, গাড়ীর ছাদে যাত্রি বহন করা, ওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা জেব্রা ক্রসিং থাকা সত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবনতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘সেইফ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১,৪১০জন গাড়ি চালক প্রশিক্ষক তৈরি ও ৩ লক্ষ গাড়ি চালকদের আপগ্রেডিং এর জন্য ১২ ও ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে লাইসেন্সবিহীন চালকরা ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহনের মাধ্যমে বৈধ লাইসেন্সের আওতায় আসবে এবং হালকা ও মধ্যম গাড়ির চালকরা ১২ দিনের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে,এ ভারী গাড়ির লাইসেন্স পাবে যা দেশে দক্ষ চালক সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।
- ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল মহাসড়কের মতো সকল মহাসড়ক এবং প্রধান সড়কে একমুখী চলাচলের সদ্ধিান্ত নিয়ে দীর্ঘ এবং উচ্চতা সম্পন্ন সড়ক বিভাজন তথা রোড ডিভাইডার-এর ব্যবস্থা করতে হবে। সকল মহাসড়ক এবং প্রধানসড়ক কে অবশ্যই ন্যুনতম চারলেনে উন্নীত করতে হবে। মহাসড়কের পাশে হাটকিুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের মত দুপাশে ধীর গতির যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা সড়ক (র্সাভসি রোড) নির্মাণ করতে হবে।
পথচারীদের নিবিঘেœ চলাচলের জন্য ফুটপথগুলো দখলমুক্ত করে যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে ফুটপাত তৈরীর ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় যেনো ফুটপাত দখল না হয় এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সকল সিটিকর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়র মহোদয়দের নিকট বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সড়কের ত্রুটিগুলো অচিরেই দূর করতে হবে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ত্রুটিগুলো দূর করার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে। একইভাবে অন্যন্য মহসড়কের ত্রুটিগুলো দূর করলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে বলেও আশা করা যায়। - দেশের ৬৬ টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সড়ক দুর্ঘটনারোধে করণীয় সম্পর্কিত যে প্রশিক্ষণ নিরাপদ সড়ক চাই ( নিসচা) এর নিজস্ব অর্থায়নে প্রদান করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষক তাদের স্কুলে যেয়ে ছাত্র-ছাত্রি, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণকে সচেতন করছে ,একই ভাবে ইমাম প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটসহ মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কে সড়ক দুর্ঘটনারোধে করনীয় সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে যাতে তারা স্ব স্ব এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনারোধে কাজ করতে পারে।
সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা
আমাদের সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই(নিসচা) মানব কল্যাণের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে বিভিন্ন কার্যক্রম অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের অকুতোভয় কর্মীরা স্বেচ্ছাসেবীর ভিত্তিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে, যাতে করে এ দেশের মানুষ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এদেশের রাজপথ যেন সড়ক দুর্ঘটনার কারণে রক্তে রঞ্জিত না হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। উল্লেখ থাকে যে, ইতোপূর্বে সরকার অথবা অন্য কোনো পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো না। ২০১২ সাল থেকে আমাদের সংগঠন নিয়মিতভাবে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আসছে।এবারোও নিসচা এরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছে। এই কাজটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। ইতোপূর্বে সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান ছিল দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ও প্রতিবেদন তৈরিতে মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করা অথবা আমাদের উপর দায়িত্ব ন্যাস্ত করে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা যাতে করে সড়ক দুর্ঘটনার গবেষণা ও পরিসংখ্যান নিখুঁত ভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়। বারবার তাগাদা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোন কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। আমাদের এই বক্তব্যগুলো আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে সকলকেই জানাবেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আপনাদের এই সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি পাশাপাশি বিগত ২৭ বছর ধরে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করে যারা আমাদের সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন দুর্ঘটনা অনুসন্ধান ও গবেষণা সেল পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় মহাসচিব সৈয়দ এহসান-উল হক কামাল, মোবাইল নং-০১৭১৬৫৫৩৬২৪।
নিরাপদে পথ চলুন,পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়।
(ইলিয়াস কাঞ্চন)
চেয়ারম্যান
[…] Leave a Comment / Posts / By Events […]