উচ্চ আদালতকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, তবে এই ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য।
সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: বিচার বিভাগ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
আসিফ নজরুল বলেন, রাষ্ট্রের যত প্রতিষ্ঠান আছে, এর মধ্যে বিচার বিভাগ নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি মনঃকষ্টে থাকতাম, খারাপ লাগতো। আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, রাষ্ট্রের যে বেসিক তিনটি অঙ্গ আছে, এরমধ্যে আইনসভা ও শাসন বিভাগ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট। আইনসভাই যারা আসেন তারা রাজনীতিবিদ, আবার রাজনীতিবিদরাই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। শুধু একটি বিভাগই আছে যেখানে সরাসরি রাজনীতি থেকে আসার সুযোগ নেই, যদি আমরা সৎ থাকি। সেটি হচ্ছে বিচার বিভাগ। আমাদের শাসন বিভাগের মন্ত্রিসভার বা আমলার এমন কোনো দুর্নীতি অনিয়ম দুঃশাসন নেই যেটা উচ্চ আদালত চাইলে বিচার করতে পারবেন না। উচ্চ আদালতের হাতে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফান্ডামেন্টাল রাইট তো বটেই, আর্টিকেল ১০২ এর আন্ডারে নন ফান্ডামেন্টাল বিষয়ও তাদের অনেক প্রতিকার দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। অ্যাপিলিয়েট ডিভিশনকে কমপ্লিট জাস্টিসের নামে বহু কিছু করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা আশ্চর্য ও বেদনার সাথে দেখেছি, উচ্চ আদালতের এই ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনামলকে শক্তিশালী করার জন্য, নির্যাতন যন্ত্রকে আরও নির্মম করার জন্য, সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করার জন্য।
তিনি বলেন, আমরা এমন আশ্চর্য ঘটনাও দেখেছি, যেখানে হাইকোর্ট জামিন দিয়ে দিয়েছেন, তারপর অ্যাপিলিয়েট ডিভিশন দিনের পর দিন জামিন ঝুলিয়ে রেখেছেন। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই, অপরাধীর বিচার হওয়ার আগেই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলে রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জেলের ভেতর মুশতাকের মৃত্যু হয়েছে। কী নির্মম, কী করুণভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল। বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে নির্যাতন, নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল।
আসিফ নজরুল আরও বলেন, দেশে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে বিচার বিভাগ কখনো এত নির্মম, এত নিপীড়ক হতে পারে না। দেশে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হলে, জনগণের রায় প্রকৃতভাবে প্রতিফলিত হলে বাংলাদেশের যে অত্যাচারী শাসক দলগুলো আছে তারা এত অত্যাচারী হতে পারে না। যখন নির্বাচন বলে কিছু থাকে না, তখন তাকে কারো কাছে জবাব দিতে হয় না, ইচ্ছামতো নির্যাতন শুরু হয় তখন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, সব সংস্কারে আমাদের নির্বাচন ভাবনা থাকে। এটা হচ্ছে মূল ভিত্তি। গণতন্ত্র বলেন, মানবাধিকার বলেন, আইনের শাসন বলেন—এটা হচ্ছে বেইস। শুধু নির্বাচন দিয়ে কী হবে, এ কথা আর বলবেন না।
তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কারের দাবি আমরা বহু বছর ধরে উচ্চারণ করে আসছি। কমপক্ষে ২০-২৫ বছর ধরে এই কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আইন করতে হবে, নিম্ন আদালতের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, উচ্চ আদালতের জন্য এটি সেক্রেটারিয়েট গঠন করতে হবে, একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিস করতে হবে, আমাদের আইনের লোফারগুলো এড্রেস করতে হবে, যাতে মামলা এত বিলম্বিত না হয়।
আসিফ নজরুল বলেন, বিচার বিভাগের পারমিশন নিয়ে সংস্কার কমিশনের পরামর্শে আমরা কিছু সংস্কার করছি। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ বাংলাদেশের সর্বনাশের অন্যতম কারণ। আমরা সারাক্ষণ শুধু নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা বলে চিৎকার করি। কিন্তু উচ্চ আদালতে যদি হয় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, সবচেয়ে বেশি পলিটিক্যাল পার্টির প্রতি অনুগত, সবচেয়ে দলবাজ তাহলে নিম্ন আদালতে স্বাধীনতা দিয়ে কী করবেন আপনি? তাই প্রথমে আমাকে উচ্চ আদালত ঠিক করতে হবে। এর জন্য প্রথমে নিয়োগটা ঠিক করতে হবে। নিয়োগের সময় যদি শুধু ‘জয় বাংলা’ ‘জিন্দাবাদ’ বলা লোক নিয়োগ পায়, তাহলে উচ্চ আদালতের কাছে আর কিছু আশা করা যায় না।
সিজিএস-এর চেয়ার মুনিরা খানের সভাপতিত্বে ও নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাড. নিতাই রায় চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক জেলা জজ এস এম বদরুল ইসলাম, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালী, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান, সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ, খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাড. রোকসানা খন্দকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ মোশারফ আহমেদ ঠাকুর, অধিকারকর্মী দিদারুল আলম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মোল্লা মহাম্মদ ফারুক আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও অধিকার কর্মী রাফিদ আজাদ সৌমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও অধিকার কর্মী ফাহিন রহমান অংকিতা।
সংলাপের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, ৫৩ বছরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক হতে পারিনি। আমরা অনেক হোঁচট খেয়েছি। কখনো সামরিক শাসন, কখনো স্বৈরশাসনের মাধ্যমে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ৯০-এর পরেও সংস্কারের রূপকল্প তৈরি করা হয়। ২০০৭-০৮ সালেও সংস্কারের কথা উঠেছে। এখন সংস্কার শব্দটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এখন সচল নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। বিচার বিভাগ ঠিক করে কাজ করলে আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে পেতাম।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, অর্থনীতিতে সংস্কার জরুরি। লুটপাট সংস্কৃতি বদলাতে হবে। আইন প্রয়োগে নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কার ও নির্বাচন দুটিই লাগবে। স্বাধীনতার পর আমাদের দরকার ছিল সাংস্কৃতিক সংস্কার। সাধারণ জনগণের সাথে সংলাপ করতে হবে। এটি না করলে আমরা সাধারণ জনগণ থেকে আলাদা হয়ে যাব। বিচার পাওয়া মৌলিক অধিকার। কিন্তু এর সাথে অর্থের সম্পর্ক কেন আসবে? দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও অর্থ বিত্তের প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত হতে হবে। সমাজের ভেতর থেকে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করা উচিত। স্বশাসিত সংস্থার কাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে। স্থানীয় জনগণকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। এটি আর্থিকভাবেও হতে হবে।
অ্যাড. নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব থাকে জনগণের কাছে। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে এটি করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের এই সার্বভৌমত্ব হরণ করা হয়েছে। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের দেশপ্রেম ছিল না। আমাদের ভূমি সংস্কার দরকার। কৃষককে ভূমি দিতে হবে। গ্রামের সালিশি আদালত জোরদার করতে হবে। লুটের অর্থনীতি পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের ব্যাপক অর্থনীতি সংস্কার করতে হবে। নিম্ন আদালতের সংস্কার করতে হবে। তদন্তকারী সংস্থাগুলোতে ভালো লোক নিয়োগ করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা এখন চলে গিয়েছে খারাপ ব্যবসায়ীদের কাছ, এটি এখন রাজনৈতিক দলের কাছে নেই। রাজনীতি করবে রাজনৈতিক দল।
মুনিরা খান বলেন, সাধারণ নাগরিক তার অধিকার বিচার বিভাগের কাছে পাবে। যারা আইনজীবী তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। সবার সুস্পষ্ট আদর্শ থাকতে হবে। এটি নাগরিকরা দেখতে চায়।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। বিচারিক হয়রানির ওপর গবেষণা করা উচিত। নতুন বাংলাদেশে এখনো আমরা ঢুকতে পারিনি। আমাদের সংস্কার এখনি শুরু করতে হবে। আইনজীবীদের গ্রেপ্তার ও তাদের ওপর হাত তোলা বন্ধ করতে হবে। জুডিসিয়ারিতে যারা যাচ্ছেন, তারা তাদের দলীয় পরিচয় বাদ দিয়ে নিজেদের মতো কাজ করতে পারেন। এখানে তাদের কাজের দক্ষতা দেখতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে নারীদের সংখ্যা কম। প্রতিবন্ধীদের সুযোগ দিতে হবে। জজদের বেতন ঠিক করতে হবে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বিচার পদে দিতে হবে। সিভিল জাস্টিসের ওপর নজর দিতে হবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, যতই সংস্কার করা হোক না কেন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার আগে করতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত হতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই আদালত অবমাননার মামলা দেওয়া যাবে না। জামিনের বিষয় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেন না যায়। বিদ্যমান মামলা নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক কাজে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা যাবে না। বিচার বিভাগের এস আলমের মতো দুর্নীতিবাজদের বাঁচানোর চেষ্টা করা যাবে না। এই চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সামনের বাজেটে ১০০ কোটি অর্থ ও ২০০০ বিচারক নিয়োগ দেন, তাহলে দেখবেন আমাদের বিচার বিভাগ ৫০ বছর এগিয়ে যাবে। আর্টিকেল ৪৮-এ যা বলা আছে, তা রাষ্ট্রপতি ১১৬ আর্টিকেলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া করতে পারেন না। ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের ওয়াশরুম ভালো না বা নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এসবের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দিতে হবে। ফেয়ার ও ইম্পারশিয়াল বিচার বিভাগ থাকতে হবে। মাইগ্রেশন রিলেটেড কোনো আদালত নেই। আইনজীবীদের সুরক্ষার জন্য আইন করতে হবে। মেধাবী ছাত্রদের ২০,০০০ টাকার ভাতা দিয়ে আইন পেশায় আনতে হবে। আইনজীবীদের গায়ে হাত তোলা বন্ধ করতে হবে।