ওবায়দুর রহমান: নিরাপদ সডক চাই’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নিসচা প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন পরিবহন চালক ও হেলপারদের সন্তানদের স্কুলে লেখাপড়ার খরচ বিনামূল্যে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেক ফিতে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, পরিবহন চালক, হেলপাররা আমাদের ভাই। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে তাদের জীবনমানের উন্নতি করতে হবে। করোনাকালে চালকদের পাশে দাঁড়ায়নি মালিকরা। কিন্তু নিসচার প্রত্যেক শাখার কর্মীরা করোনার মধ্যে গণপরিবহন বন্ধের সময় নিজেরা ঈদ করার আগে সাধ্যমতো পরিবহন চালকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এই দেশের মানুষ না খেয়ে থাকলে আমি খেতে চাই না। এই দেশের মানুষ কষ্টে থাকলে আমি সুখে থাকতে চাই না। সড়ক দুর্ঘটনারোধে আইন ছাড়া মানুষকে সচেতন করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু আইনের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না- এই কথাটি যারা বলেন তা ঠিক নয়।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনারোধে গঠিত টাস্কফোর্সের ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়ন দুই-এক বছরের মধ্যে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, এ ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এ দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করেছেন। দুই এক বছরে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম অডিটরিয়ামে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একটা সময় ঢাকা-আরিচা সড়ক মরণফাঁদ ছিল। সেখানে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটত। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই সড়ক মেরামত করেছে। দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গাগুলো চিহিৃত করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। বর্তমানে ওই সড়কে দুর্ঘটনা অনেক কমে গেছে। দেশের এ রকম অনেক জায়গায় সড়ক সংস্কারের মাধ্যমে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেক কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। বিদেশে ২০ শতাংশ সড়ক থাকে। আমাদের সেই সুযোগ নেই। আমাদের দেশে ৮ শতাংশ সড়ক ছিল সরকার সেটাকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশের মতো করেছে। এছাড়া মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ডেভেলপ কান্ট্রিতে উন্নীত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
মন্ত্রী বলেন, জার্মানিতে ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে অনেক সড়কে গাড়ি চলে। কিন্তু আমাদের মতো জনবহুল দেশে তা সম্ভব নয়। আমরা আইন ভঙ্গকারী জাতি হিসেবে পরিণত হচ্ছি। ঢাকা শহরে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সেই সময় হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল।
তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। সব ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অনেক গাড়ি থেকে হাইড্রোলিক হর্ন খুলে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার চলছে। হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের বিষয়টি দেখবো। এছাড়া সড়কে দুর্ঘটনা আরও কমিয়ে আনতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মহাসড়কে বাস বে, ট্রাক বে নির্মাণের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু জায়গায় এটা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর যাতে চালকরা সেখানে বিশ্রাম নিতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চালক কতক্ষণ গাড়ি চালাবে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় একজন চালক সারা রাত গাড়ি চালানোর পর আবার তাকে সকালে গাড়ি চালনোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটা যাতে না হয় তা দেখতে হবে। প্রয়োজনে চালককেও এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরকে স্মার্ট সিটি করার পরিকল্পা রয়েছে। এতে পুরো শহর ক্যামেরার আওতায় চলে আসবে। তবে এটা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ।
অনুষ্ঠানে নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমাদের নিজেদের পয়সা দিয়ে আমরা মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। কমিটির সদস্যদের মাটির ব্যাংকে জমা রাখা গচ্ছিত টাকা ভেঙ্গে সেই অর্থ দিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে ৫০টি সেলাই মেশিন বিতরণ করা হচ্ছে। এই ৫০ সেলাই মেশিনের বাইরেও আরও ৫০টি দেওয়া হবে শাখা কমিটির পক্ষ থেকে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পবিারের সদস্যরা উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। পগুত্ব বরণকারী ব্যক্তিরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
এ পরিবারগুলো যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিতে পারে সে কারণে তাদের মাঝে সেলাই মেশিন তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, যতদিন নিসচা থাকবে ততদিন দেশের মানুষের পাশে থাকবো। তিনি বলেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন শুরু করেছিলাম। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করতে যাচ্ছি। আমি বুকের মধ্যে বাংলাদেশকে লালন করি। আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করি। সমাজের প্রত্যেকে যে যেখানে আছে সেখান থেকে কাজ করলে তার কাজের প্রমাণ হবে।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে গঠিত টাস্কফোর্সের ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে জোর দিয়ে নিসচা চেয়ারম্যান বলেন, এই সুপারিশ বাস্তবায়নে যত দেরি হবে তত বেশি প্রাণহানি ঘটবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সুপারিশ বাস্তবায়িত হবে তত প্রাণহানি কমবে। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুফল ঘরে আসবে।
পরে মন্ত্রীর হাত থেকে সেলাই মেশিন গ্রহণ করেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইউসুফ আলী মোল্লা, নিসচা উপদেষ্টা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ম হামিদ ও বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন নিসচার মহাসচিব সৈয়দ এহসান-উল হক কামাল। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নিসচার যুগ্ম মহাসচিব সাদেক হোসেন ও সাংগঠনিক স¤পাদক এস এম আজাদ হোসেন। অনুষ্ঠানে নিসচা যুগ্ম মহাসচিব লিটন এরশাদ সম্পাদিত ‘নিরাপদ’ স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধান অতিথি ও অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।
সেলাই মেশিন গ্রহণকালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বাস চালক কাজী মিজানের সহধর্মিনী শিউলী আক্তার বলেন, স্বামীর আয়ে আমাদের পরিবার বেশ ভালোই চলছিল। ২০১৮ সালের এপ্রিলে উল্টোপথে বেপরোয়া বাসের আঘাতে মারা যান স্বামী। এরপর তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে চরম বিপদে পড়েছি। আমার সোনার সংসার তছনছ হয়ে গেছে। এই দুঃসময়ে আমি একমাত্র নিরাপদ সড়ক চাইকে পাশে পেয়েছি।