করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তবে এ অবস্থায় বাংলাদেশ যেন কখনোই সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কবলে না পড়ে সেজন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, এটি আমার কথা নয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলা হচ্ছে যে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। দুর্ভিক্ষ আমাদের দেশকে কখনই যেন ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সেজন্য এখন থেকেই আমাদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোববার (২৭ নভেম্বর) নিজ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সচিব সভার সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সভায় বেশ কয়েকটি প্রস্তাব বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। যার মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী হওয়া, অগ্রাধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারণ, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং প্রতি ইঞ্চি পতিত জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসতে মানুষকে সচেতন করা এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহারে যথাসম্ভব সাশ্রয়ী হওয়া।
সরকারপ্রধান বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি যখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিপর্যস্ত, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি করেছে। একটি বা দুটি দেশ এ সংকটের সুবিধা পেলেও উন্নত দেশসহ বাকি দেশগুলো কষ্টে রয়েছে।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোও গুরুতর সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। যে কারণে অনেক দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রিজার্ভ কমছে। বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বহুগুণ বেড়েছে। আমাদের দেশও এর আওতার বাইরে নয় এবং এটি আমাদের দেশেও আঘাত করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যারা রেমিটেন্স পাঠায় তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ ও প্রণোদনা আমরা দিয়েছি। পাশপাশি আমাদের ভাল রিজার্ভ রয়েছে। আমাদের তিন মাসের খাদ্য কেনার মতো রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট। সেখানে আমাদের ৫/৬ মাসের রিাজার্ভ আছে। তারপরও আমাদের এখন যা অবস্থা তাতে আরেকটু সাশ্রয়ী ও সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা এখনই যে বিপদে পড়েছি তা কিন্তু না। কিন্তু আমার কথাটা হচ্ছে আগাম ব্যবস্থাটা নিতে হবে। যেন ভবিষ্যতে দেশ বা দেশের মানুষ কোনো বিপদে না পড়ে। আমাদের সেই সতর্কতা একান্তভাবে দরকার এবং সেই সতর্ক বার্তাটাই কিন্তু আমরা দিচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। এটার ওপরও আমাদের গুরুত্ব দেওয়া একান্তভাবে দরকার।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যেন যে কেউ যে কোনো তথ্য সেখান থেকে জানতে পারে, নিতে পারে। সেখানে আমাদের সাফল্যগুলো তুলে ধরতে হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে যদি এ সাফল্যগুলো প্রতিনিয়ত আপডেট করে সেগুলো তুলে ধরে তাহলে মানুষ কিন্তু জানতে পারবে, কী কী কাজ আপনারা করলেন।
ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়াসহ মানুষের কল্যাণে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও সভায় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের অনেক জিনিস এখনো কিনতে হয়। যেসব জিনিস আমাদের বাইরে থেকে কিনতে হয় এরমধ্যে যে সব জিনিস আমরা দেশে উৎপাদন করতে পারি সেদিকে আমাদের এখন দৃষ্টি দিতে হবে। যেন দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারি। অন্তত বাইরের ওপর নির্ভরশীলতা যেন যতটা সম্ভব কমাতে পারি।
বিদ্যুৎ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য জ্বালানি তেল বা গ্যাসের দাম বাড়ায় এক্ষেত্রেও বাংলাদেশে কিছুটা সমস্যা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আগামীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে এলে সংকট অনেকাংশে কেটে যাবে বলে আভাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে আমাদের গ্রিড লাইন নির্মাণকাজ আরও দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
এসময় তিনি সবাইকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কথা তুলে ধরার পাশপাশি দেশকে এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে এবং সেভাবে মানুষকে সঙ্গে নিজে কাজ করতে হবে।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, আমরা যে স্বাক্ষরতার হার বাড়িয়ে প্রায় ৭৫ ভাগে উন্নীত করতে পেরেছি সেটা ধরে রাখতে হবে। আমরা এখন ডিজিটাল শিক্ষা গ্রামের প্রাইমারি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি, সেটাও আমাদের ধরে রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি, সেগুলোও যেন চলমান থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। সর্বোপরি খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেখান থেকে বিনিয়োগ আসে সেগুলো সম্পর্কে আমাদের নজরে দিতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্ড়ে যেন এটা কার্যকর হয়।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের সব পরিকল্পনা বা প্রকল্প বাছাই করতে হবে। বাছাই প্রক্রিয়া শেষে কোনগুলো দ্রুত শেষ করা যায় সেগুলো আগে শেষ করে নতুনগুলো ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাদক সমাজে বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের একটা ঘটনা ঘটেছিল হলি আর্টিজানে। আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেটা নিয়ন্ত্রণ করি। তারপর থেকে আর বাংলাদেশে এরকম কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়নি। কিন্তু তারপরও এ ব্যাপারে সব সময় সজাগ থাকতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদক আর জঙ্গিবাদ থেকে আমাদের যুব সমাজ যেন দূরে থাকে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া একান্তভাবে দরকার।
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক পরিস্থিতিতে ভালো ও মন্দ দুই ধরনের প্রভাবই পড়েছে। অনেক সময় অপপ্রচারের মুখোমুখিও হতে হয়। এসব বিষয়েও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।