এস এম আজাদ হোসেন, পবিত্র মদিনা মনোয়ারা থেকে ফিরে: (আরবি: غزوة أحد Ġazwat ‘Uḥud) ৩ হিজরির ৭ শাওয়াল (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ, হিজরি ৩, শনিবার) উহুদ পর্বতের সংলগ্ন স্থানে সংঘটিত হয়।মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই দুই পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে মুহাম্মাদ(সঃ) ও আবু সুফিয়ান। ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত প্রধান যুদ্ধসমূহের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। এর পূর্বে ৬২৪ সালে এই দুইপক্ষের মধ্যে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মক্কার পক্ষ থেকে এই যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছিল। যুদ্ধযাত্রার খবর পাওয়ার পর মুসলিমরাও তৈরী হয় এবং উহুদ পর্বত সংলগ্ন প্রান্তরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা প্রথমদিকে সাফল্য লাভ করেছিল এবং মক্কার সৈনিকরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিজয়ের খুব কাছাকাছি থাকা অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর কিছু অংশের ভুল পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। মুহাম্মাদ (সঃ) মুসলিম তীরন্দাজদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, ফলাফল যাই হোক তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসে। কিন্তু তারা অবস্থান ত্যাগ করার পর মক্কার বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিমদের উপর আক্রমণের সুযোগ পান ফলে মুসলিমদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরী হয়। এসময় অনেক মুসলিম নিহত হয়। মুহাম্মাদ(সঃ) নিজেও আহত হয়েছিলেন।তাঁর দানদান মোবারক শহীদ হয়। মুসলিমরা উহুদ পর্বতের দিকে পিছু হটে আসে। মক্কার বাহিনীকে এরপর মক্কায় ফিরে আসে।
পটভূমিঃ
বদরের যুদ্ধে মক্কার কয়েকজন প্রধান গোত্রপ্রধান নিহত হন। ক্ষয়ক্ষতির কারণে নেতৃস্থানীয়রা প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিমরা যাতে তাদের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে বুঝতে না পারে সেজন্য নিহতদের শোক প্রকাশ এবং যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ আদায় নিয়ে তাড়াহুড়া করতে নিষেধ করা হয়। আরেকটি যুদ্ধের জন্য পুনরায় প্রস্তুতি শুরু হয় এবং এতে ইকরিমা ইবনে আবি জাহল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও আবদুল্লাহ ইবনে রাবিয়াহ অগ্রগামী ছিলেন।
যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য আবু সুফিয়ানের যে কাফেলাটি বদরের সময় রক্ষা পেয়েছিল তার সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে দেয়া হয়। এই কাফেলায় যাদের মালামাল ছিল তারা এতে সম্মতি দেয়। এই সম্পদের পরিমাণ ছিল এক হাজার উট এবং পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিভিন্ন অঞ্চলের গোত্রগুলির প্রতি কুরাইশদের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এক বছরের মধ্যে যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ৬২৫ সালের ১১ মার্চ ৩,০০০ সৈনিক নিয়ে গঠিত মক্কার বাহিনী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মদিনার দিকে যাত্রা করে। এই বাহিনীর সাথে ৩,০০০ উট ও ২০০টি ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাসহ মক্কার ১৫জন নারীও যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করে। কুরাইশ নেতাদের ধারণা ছিল যে, নারীরা সাথে থাকলে তাদের সম্মান রক্ষার জন্য বেশি আমরণ লড়াইয়ের উদ্দীপনা তৈরী হবে।[তারা সরাসরি মদিনা আক্রমণ না করে শহরের নিকটে আকিক উপত্যকা অতিক্রম করে কিছুটা ডানে উহুদের নিকটবর্তী আয়নাইনে শিবির স্থাপন করে। হিন্দ বিনতে উতবা প্রস্তাব দেন যে, মুহাম্মাদের (সঃ) মায়ের কবর যাতে ধ্বংস করে দেয়া হয়। কিন্তু এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে ভেবে নেতারা প্রস্তাবে সম্মতি জানাননি।
যুদ্ধযাত্রার খবর মুহাম্মাদের (সঃ) কাছে পৌছায়। এরপর মদিনার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অনেকে নিয়োজিত হয়। যুদ্ধের জন্য গৃহিতব্য পদক্ষেপ নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথা জানান।
তিনি বলেন-
আল্লাহর শপথ আমি একটি ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখি য্ কতগুলি গাভী জবাই করা হচ্ছে। আরো দেখি যে, আমার তলোয়ারের মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর এও দেখি যে, আমি আমার হাত একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে ঢুকিয়েছি।
এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন যে কিছু সাহাবি নিহত হবে, তলোয়ালের ভঙ্গুরতার অর্থ তার পরিবারের কেউ শহীদ হবে এবং সুরক্ষিত বর্মের অর্থ মদিনা শহর।
যুদ্ধের কৌশল ও পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। মুহাম্মাদ (সঃ) সহ কারো কারো মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা। কারণ মদিনা সুরক্ষিত শহর ছিল এবং প্রতিপক্ষ নিকটবর্তী হলে সহজে তাদের আক্রমণ করা যেত এবং নারীরা ছাদের উপর থেকে ইট পাটকেল ছুড়তে পারত। অন্যদিকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবসহ কিছু সাহাবি ভিন্নমত দেন। তাদের দাবি ছিল এভাবে শহরের ভেতর থেকে প্রতিরক্ষা করলে শত্রুর মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং অগ্রসর হয়ে খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস করবে না।
এর ফলে মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১,০০০। এর মধ্যে ১০০ জন বর্ম পরিহিত ছিল এবং ৫০ জন ছিল অশ্বারোহী। মুহাম্মাদ (সঃ) মুসলিম বাহিনীকে তিনভাবে বিভক্ত করেন। এগুলি হল, মুহাজির বাহিনী, আউস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। এই তিন বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির।
প্রায় ১,০০০ মুসলিমের বাহিনী মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়। তারা শাওত নামক স্থানে পৌছানোর পর ইতিপূর্বে শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানানো আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে। এর ফলে ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমরা উহুদের দিকে যাত্রা করে। যাত্রাপথে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করা হয় এবং পথপ্রদর্শক আবু খাইসামা এসময় প্রতিপক্ষকে পশ্চিমে ছেড়ে দিয়ে বনি হারিসা গোত্রের শস্যক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে ভিন্ন একটি পথ অবলম্বন করে উহুদের দিকে মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে যান।
এরপর মুসলিমরা উপত্যকার শেষ প্রান্তের উহুদ পর্বতে শিবির স্থাপন করে। এই অবস্থানে মুসলিমদের সম্মুখে ছিল মক্কার বাহিনী ও পেছনে ছিল উহুদ পর্বত এবং মদিনা ও মুসলিম বাহিনীর মধ্যবর্তী স্থানে মক্কার বাহিনী অবস্থান করছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছানোর পর সেনাবিন্যাস করা হয়। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ইবনে নুমানের নেতৃত্বে ৫০ জন দক্ষ তীরন্দাজের একটি দলকে কানাত উপত্যকার দক্ষিণে মুসলিম শিবিরের পূর্বদক্ষিণে ১৫০ মিটার দূরে জাবালে রুমাত নামক একটি ছোট পাহাড়ে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়। তারা মুসলিম বাহিনীকে পেছনের গিরিপথের দিক থেকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে এবং তাদের অবস্থানের কারণে বাম পার্শ্বেও ঝুঁকি কমে যায়। অন্যদিকে ডান পার্শ্ব উহুদ পর্বতের কারণে সুরক্ষিত ছিল। এর ফলে মুসলিমরা প্রতিপক্ষের হাতে আবদ্ধ হওয়ার ঝুকি ছিল না।
মুহাম্মাদ (সঃ) তীরন্দাজদের নির্দেশ দেন যাতে তিনি নির্দেশ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তীরন্দাজরা কোনো অবস্থায় তাদের স্থান থেকে সরে না আসে। তিনি নির্দেশ হিসেবে বলেন,
তোমরা আমাদের পিছন দিক রক্ষা করবে। যদি তোমরা দেখ যে আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে না। আর যদি দেখতে পাও যে আমরা গনিমতের মাল একত্রিত করছি তবে তখনও তোমর আমাদের সাথে যোগ দেবে না।
বাকি সৈন্যদের বিভিন্ন ভাগে বিন্যস্ত করা হয়। বাহিনীর ডান পার্শ্বের নেতৃত্ব মুনজির ইবনে আমর ও বাম পার্শ্বের নেতৃত্ব যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে দেয়া হয়। মিকদাদ ইবনে আসওয়াদকে যুবাইরের সহকারী নিযুক্ত করা হয়। বাম পার্শ্বের দায়িত্ব ছিল মক্কার বাহিনীর ডান পার্শ্বের নেতৃত্বে থাকা খালিদ বিন ওয়ালিদের অশ্বারোহীদের প্রতিরোধ করা। এছাড়াও সম্মুখসারিতে দক্ষ সৈনিকদের নিযুক্ত করা হয়।
অপরদিকে, মক্কার বাহিনীর মূল ভাগের নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। তিনি বাহিনীর মধ্যস্থলে নিজ কেন্দ্র তৈরী করেন। বাম ও ডান পার্শ্বের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে ইকরিমা ইবনে আবি জাহল এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ। পদাতিক ও তীরন্দাজদের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া ও আবদুল্লাহ ইবনে রাবিয়াহ। রীতি অনুযায়ী বনু আবদ আদ-দার গোত্রের একটি দল মক্কার বাহিনীর পতাকা বহন করছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে আনসারদেরকে আবু সুফিয়ান বার্তা পাঠিয়ে জানান যে তারা যদি মুহাজির মুসলিমদেরকে ত্যাগ করে তাহলে তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না এবং শহর আক্রমণ করা হবে না। কিন্তু আনসাররা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
মদিনাত্যাগী আবু আমর মক্কার পক্ষে প্রথম আক্রমণ চালায়। মুসলিমদের তীরের বৃষ্টিতে আবু আমর ও তার লোকেরা পিছু হটে মক্কার সারির পেছনের দিকে সরে আসে। এরপর মক্কার পতাকাবাহক তালহা ইবনে আবি তালহা আল-‘আবদারি এগিয়ে গিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান করেন। যুবাইর ইবনুল আওয়াম আহ্বান শুনে এগিয়ে যান এবং তালহাকে হত্যা করেন। তালহার ভাই উসমান ইবনে আবি তালহা এগিয়ে গিয়ে পড়ে যাওয়া পতাকা তোলেন। মুসলিমদের মধ্যে থেকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এগিয়ে এসে তাকে হত্যা করেন। মক্কার পতাকা বহনের দায়িত্ব তাদের পরিবারের উপর ন্যস্ত ছিল। একারণে তালহার ভাই ও পুত্রসহ ছয়জন একের পর এগিয়ে আসে এবং সবাই নিহত হয়।
দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর দুই বাহিনীর মধ্যে মূল লড়াই শুরু হয়। যুদ্ধে আগত কুরাইশ নারীরা দফ বাজিয়ে সেনাদের উৎসাহ দিচ্ছিল। মুসলিমরা মক্কার সৈনিকদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় মক্কার বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মক্কার অশ্বারোহীরা তিনবার মুসলিম বাহিনীর বাম পার্শ্বে আক্রমণ চালাতে চেষ্টা করে কিন্তু জাবালে রুমাতের উপর মোতায়েন করা তীরন্দাজদের আক্রমণের কারণে তারা বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিমরা সুবিধাজনক অবস্থান লাভ করে এবং বিজয়ের নিকটে পৌছে যায়। এসময় মুসলিম তীরন্দাজদের একটি বড় অংশ নির্দেশ অমান্য করে পাহাড় থেকে নেমে আসে এবং মূল বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। ফলে বাম পার্শ্বের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে খালিদের নেতৃত্বাধীন মক্কার অশ্বারোহীরা সুযোগ কাজে লাগায়। নির্দেশ মেনে অবস্থান ত্যাগ না করা অবশিষ্ট তীরন্দাজদের উপর তারা আক্রমণ চালালেও সংখ্যা স্বল্পতার কারণে খালিদের অশ্বারোহিদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে মক্কার বাহিনী মুসলিম বাহিনীর পার্শ্বভাগ ও পেছনের ভাগে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়। এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় অনেক মুসলিম মারা যায়। একটি ক্ষুদ্র অংশ দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং মদিনার দিকে অগ্রসর হয়। মক্কার বাহিনীর আক্রমণে মুহাম্মাদ(সঃ) আহত হন এবং তার একটি দাঁত ভেঙে যায়। কিন্তু গুজব ছড়ায় যে তিনি নিহত হয়েছেন।
তীব্র সম্মুখযুদ্ধের পর অধিকাংশ মুসলিম উহুদ পর্বতের ঢালে জমায়েত হতে সক্ষম হয়। মুহাম্মাদ (সঃ)ও পর্বতের উপরের দিকে আশ্রয় নেন। মক্কার সেনারা পর্বতের দিকে অগ্রসর হয় কিন্তু উমর ইবনুল খাত্তাব ও মুসলিমদের একটি দলের প্রতিরোধের কারণে বেশি এগোতে সক্ষম হয়নি। ফলে লড়াই থেমে যায়।
হিন্দ ও তার সঙ্গীরা এসময় মুসলিমদের লাশ টুকরো করে, লাশের কান, নাক কেটে পায়ের গয়নার মত পরিধান করে। যুদ্ধ চলাকালে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইথিওপীয় দাস ওয়াহশি ইবনে হারবের বর্শার আঘাতে নিহত হয়েছিলেন। হামজাকে হত্যা করতে পারলে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি পাওয়ার কারণে ওয়াহশি হামজাকে হত্যা করেছিলেন। হিন্দ নিহত হামজার কলিজা বের করে চিবিয়েছিলেন।
মুসলিমরা পর্বতে আশ্রয় নেয়ার পর আবু সুফিয়ানের সাথে উমরের কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। কথোপকথনের সময় আবু সুফিয়ান এই দিনকে বদরের প্রতিশোধ বলে উল্লেখ করেন। প্রতি উত্তরে উমর বলেন যে, মুসলিমদের নিহতরা জান্নাতে এবং কাফির নিহতরা জাহান্নামে আছে। এরপর মক্কার বাহিনী মক্কাভিমুখী যাত্রা করে। মুসলিমরা নিহত সৈনিকদেরকে যুদ্ধের ময়দানে দাফন করে।
প্রথম দিকে মুসলিমরা সুবিধাজনক স্থানে থাকলেও এক পর্যায়ে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কুরাইশদের হাতে চলে যায়। বিশৃখল অবস্থায় পড়ে যাওয়া মুসলিমরা এরপর পর্বতে জমায়েত হতে সক্ষম হয়। কুরাইশরা এরপর আর অগ্রসর হয়নি এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ীদের তিনদিন অবস্থানের তৎকালীন রীতি পালন না করে ফিরে যায়। ফলে শেষপর্যায়ে মুসলিমদের তুলনামূলক বেশি ক্ষয়ক্ষতি ও কুরাইশদের সুবিধাজনক অবস্থান সত্ত্বেও যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়।
এই যুদ্ধে পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ের পূর্বে আরব যুদ্ধকৌশলের কিছু দিক স্পষ্ট হয়। আরবরা মূলত ঝটিকা আক্রমণ করত এমনটা ধারণা করা হলেও এক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। মক্কার বাহিনী এখানে অশ্বারোহীদের পূর্ণ ব্যবহার করেছে।
মুহাম্মাদ (সঃ) সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। উহুদকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। মুসলিমদের ইচ্ছানুযায়ী তিনি খোলা ময়দানে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও মক্কা বাহিনীর অধিক চলাচল সক্ষমতার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। খোলা ময়দানে লড়াইয়ের ফলে মুসলিম পদাতিকদের পার্শ্বগুলি আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তিনি বাহিনীর পেছনের দিকে উহুদ পর্বতকে রেখে লড়াই করেন। এর ফলে পেছনের দিক থেকে কোনো আক্রমণ আসেনি। তাছাড়া সামনের অংশ প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ গজ ছিল। একটি পার্শ্বভাগকে পর্বতের পাশে এবং অন্য পার্শ্বভাগকে পর্বতের গিরিপথের দিকে মোতায়েন করা হয়। তাই সামরিক দিক থেকে উভয় অংশ মক্কার অশ্বারোহীদের থেকে সুরক্ষিত ছিল। যে পথে আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সেদিকে তীরন্দাজদের স্থাপন করা হয়। অশ্বারোহী প্রধান বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক প্রধান বাহিনীর কীভাবে লড়াই করা উচিত এই যুদ্ধে তার নমুনা দেখতে পাওয়া যায়।
এই যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবে নিজের সামর্থ্য প্রদর্শন করেছেন। মুসলিম তীরন্দাজদের ভুল পদক্ষেপ নজরে পড়ার পর তিনি সুযোগ গ্রহণ করেন। ফলে মুসলিমরা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন। পরবর্তীতে পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ের সময় খালিদ সবচেয়ে সফল মুসলিম সেনাপতি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।