চিত্রালী সম্পাদক ও চলচ্চিত্র প্রোযোজক-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ-এর ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৭৯ সালের ২ এপ্রিল, লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫ বছর। তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রশিল্পের এই মহিরূহব্যক্তিত্বের প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধা । তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি ।
সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ (এস,এম,পারভেজ) ১৯৩৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈতিৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ে। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ বায়েজিদ। তিনি ১৯৫২ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। সেই বছরই তৎকালীন ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার ফিচার লেখক হিসাবে যোগ দেন, শুরু হয় তাঁর সাংবাদিকতার জীবন ।
১৯৫৩ সালে, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ বের করেন। হন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ।
একসময় এ দেশের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’। শিল্প-সাহিত্যের অনেক রথী-মহারথীদের জন্ম হয়েছে এই ‘চিত্রালী’র মাধ্যমে । বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে ‘চিত্রালী’র ভূমিকা অবশ্যই স্মরণযোগ্য ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের অগ্রগতির জন্য সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজের অবদান সর্বজন স্বীকৃত । তিনি দেশীয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমন্বয়ে ১৯৫৯ সালে, চলচ্চিত্র প্রযোজক হয়ে নির্মাণ করেন ‘মাটির পাহাড়’ । ছবিটি ব্যবসাসফল হয়নি । ফলে তিনি নিদারুণ অর্থ দৈন্যের মধ্যে পরে যান। তাই বাধ্য হয়ে ‘চিত্রালী’র প্রকাশনাসত্ব অবজারভার গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করেন । যদিও মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি চিত্রালীর সম্পাদক ছিলেন । ১৯৭৭-এ তিনি সাপ্তাহিক ‘কিশোর বাংলার’ সম্পাদক হন।
তিনি চিত্রপরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় এস এম পারভেজ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কারওঁয়া’ । তাঁর পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি ‘বেগানা’ মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে।
নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যারাও বা জানেন তাদের মধ্যে ক’জনই বা তাকে মনে রেখেছেন । ক’জনই বা স্মরণ করেন তাকে, বলেন তাঁর কথা ।
যখন এ দেশে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা হয়তো কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি । সেই সময়ে এ দেশে নিয়মিত সিনেমা বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রকাশক ও সম্পাদক হয়ে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন, সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। এদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশ, শিল্প-সংস্কৃতি অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম । ছিলেন চলচ্চিত্রশিল্পের-চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের
অতি আপনজন।
একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী ছিলেন । মস্কো, তাসখন্দ, দিল্লি ও করাচিতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন । বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডের চলচ্চিত্র কেন্দ্রগুলোও পরিদর্শন করেন । তদানীন্তন ‘পাকিস্তান ফিল্ম ইন্সটিটিউটে’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি । ১৯৬৪ সালে, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ উদ্যোক্তাদের তিনি ছিলেন অন্যতম একজন । ১৯৬৫ সালে, অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ জুরিবোবোর্ডের সদস্য ছিলেন । ১৯৭৬ থেকে টানা তিন বছর তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটি ও বিচারকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন । বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সরবোর্ডের সদস্য ছিলেন । ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য । মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বাচসাস-এর সভাপতি পদে বহাল ছিলেন । তিনি ছিলেন কিশোর সংগঠন ‘চাঁদের হাট’-এর প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা এবং ‘চিত্রালী পাঠক-পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ’ (চিপাচস)-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ।
এদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের নানা দুঃসময়ে তিনি রেখেছেন কার্যকরী ভূমিকা। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার বিশ্বস্ত অভিভাবক । ৪২ বছর আগে লোকান্তরিত হয়েছেন তিনি । শারীরিকভাবে তিনি অনুপস্থিত সত্বেও, তাঁর ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, কর্মময় জীবনধারা আজও আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাখছে অনন্য ভূমিকা ।
এদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশ, শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে তাঁর অনন্য অবদানের কথা অবশ্য অবশ্যই চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা তথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চির অমর হয়ে থাকবেন সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ।