২০১৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গৌরীপুরে প্রায় ৩০ থেকে ৩৪ জন যাত্রী নিয়ে ‘মতলব এক্সপ্রেস’ নামে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে ডোবায় পড়ে যায়। এ সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার কনস্টেবল পারভেজ মিয়া। পারভেজ তাকিয়ে দেখেন পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত ডোবায় ডুবে যাচ্ছে বাসটি। হাতে সময় নেই, কিছু চিন্তা না করেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ডোবায়। গাড়ির জানলার কাঁচ ভেঙে ভেতর গিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ২৫ থেকে ২৬ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন।
এ সাহসিকতার জন্য তাকে দেওয়া হয় পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) সহ নিরাপদ সড়ক চাই ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নানান সন্মাননা পুরস্কার।
সারাদেশে প্রশংসায় ভাসতে থাকেন পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ মিয়া। এরপর ১বছরের মাথায় পারভেজের জীবনে ঘটে যায় ভয়ংকর এক ঘটনা। দায়িদ্বরত অস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পা হারান সেই সাহসী পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ মিয়া। গজারিয়া উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তাকে ধাক্কা দেয় একটি বেপরোয়া কাভার্ডভ্যান। এতে ডান পায়ের গোড়ালি ও হাতে মারাত্মক জখম হয়। জীবন বাঁচাতে ডাক্তাররা অপারেশন করে তার ডান পা কেটে বাদ দেন।
কাভার্ড ভ্যানের এক ধাক্কা চুরমার করে দেয় সব। পারভেজের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। যে পায়ে ভর দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিল মৃত্যু পথযাত্রী ২৫ জন বাস যাত্রীর, যে পায়ে ভর করে দাঁড়াতে চেয়েছিল একটি পরিবার, সে পা’ই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যায়। এত কিছুর পরও দমে যায়নি পারভেজ। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তিনি। তিনি এত সহজে দমে যাবার পাত্র নন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পারভেজ সুস্থ্য হন। তাঁর কাটা অঙ্গে লাগানো হয় কৃত্রিম পা। সেই পায়ে ভর করে তিনি আবার দাড়ান। এবং দুর্ঘটনাস্থলের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগদান করেন। বর্তমানে সেখানেই তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।
পারভেজ মিয়ার অতীতের সেই দিনের স্মৃতিগুলো তাকে এখনো গর্বিত করে। মানুষের সেবার জন্য শপথ নিয়েই পুলিশ বাহিনীতে আসা তার। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে বড় কাজ আর হতে পারে না বলে মনে করেন তিনি। তার বাবা দেশবাসীকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে যে যুদ্ধ করেছেন, সেখান থেকেই মানবসেবার আদর্শ গ্রহণ করেছেন পারভেজ। পারভেজ বর্তমানে ভালো আছেন। যদিও কৃতিম পা তারপরও তিনি হাটা চলা ফেরা করতে পারছেন। তিনি ডিউটি করতে পারছেন। পাশাপাশি নিয়মিতভাবে চলছে তার মানবিক কাজগুলো।
মেঘনা হাইওয়ে পুলিশ কমান্ড এন্ড মনিটরিং সেন্টারে সারাদিন সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি করছেন নানা মানবিক কাজ। অফিস শেষ করেই তিনি বেড়িয়ে পড়ের মানবিক কাজের পেছনে। শীতের ভেতর বস্ত্রহীনদের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ। অনাহারে কেউ পড়ে আছে জানা মাত্র রাতের আধারে খাদ্য নিয়ে সেখানে পারভেজ হাজির। করোনায় অসহায় দরিদ্র পরিবারের মাঝে নিজ উদ্যোগে সহায়তা প্রদানসহ সড়ক দুর্ঘটনারোধে সচেতনতামুলক নানা কাজ তার চলমান রয়েছে। সম্প্রতি তিনি দুর্ঘটনায় পা হারানো এক যুবককে কৃতিম পা লাগিয়ে দিলেন।
পারভেজ নিরাপদ নিউজকে বলেন, কিছুদিন আগে বড়বােন এক অসহায় লােককে লাঠি নিয়ে হাটতে দেখে খুব কষ্ট পায়, এরপরই আমাকে জানায়, সড়ক দুর্ঘটনায় তোর পা চলে গেলেও সরকার থেকে তোকে হাটার জন্য কৃত্রিম পা লাগিয়ে দিয়েছে। একটি অসহায় লােক যার দুটা পা থাকলে স্বাভাবিকভাবে হাটতে পারেনা তাই তুই তাকে হাটার জন্য দুটা স্টেচার কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। বােনের এমন আবদার শুনে ঢাকা গিয়ে নিজেই কিনে আনলাম দুটো স্টেচার। এবং সেই লােককে খুঁজে এনে স্টেচার উপহার দেই। অসহায় ভাইকে হাটাতে পের মনের তৃপ্তি পেলাম। উনি এখন ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারছেন।
পারভেজ মিয়া বলেন, মানবসেবা করতে পেরে নিজেকে খুব ভালো লাগে। মানুষের ভালোবাসাআমার কর্মজীবনে ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায়। আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা। তার নীতি ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার জীবন গড়ে তুলেছি। আমি সব সময় চেষ্টা করি অসহায় গরীব দুঃখি মানুষের পাশে দাড়াঁনাের জন্য, আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী সব সময় চেষ্টা করি তাদের জন্য কিছু করার। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন সব সময় দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করে যেতে পারি।