চলতি পথে হঠাৎ বিকল ট্রেনের ইঞ্জিন। আশেপাশে স্টেশন নেই। বিকল্প আরেকটি ইঞ্জিন এসে ট্রেন সচল করতে প্রায় এতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। এত দীর্ঘ সময় ট্রেনে বসে থাকতে গিয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠের যাত্রী ও ট্রেনের স্টাফরা। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা পড়ে মহাবিপাকে। তাদের এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন এলাকাবাসী। যার ঘরে যা রান্না করা খাবার ছিল তাই দিয়ে সবার ক্ষুধা নিবারণ করেন।
এমনই এক অবিস্মরণীয় মানবিক ঘটনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার তাঁতীবন্ধ এলাকার মানুষ।
রোববার বেলা ১১টার দিকে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ ঘটনার পর ট্রেনে থাকা বিভিন্ন এলাকার মানুষদের প্রশংসায় ভাসছেন সাঁথিয়া উপজেলার তাঁতীবন্ধ এলাকার মানুষরা।
পাকশী পশ্চিমাঞ্চল বিভাগীয় রেলওয়ের টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু জানান, পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে চলাচল করে ঢালারচর এক্সপ্রেস। রোববার সকাল সাতটার দিকে ট্রেনটি ঢালারচর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
আমি ওই ট্রেনের দায়িত্ব পালন করছিলাম। পথে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে সাঁথিয়ার রাজাপুর স্টেশন পার হওয়ার পরে হঠাৎ করেই ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। পরে ঈশ্বরদী থেকে বিকল্প ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুনরায় ট্রেনটি চালু করতে বেলা ১১টা ৪০ মিনিট বেজে যায়।
টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ট্রেনের যাত্রী আর স্টাফদের এমন করুণ অবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন রেললাইন থেকে কিছু দূরে বসবাসকারী মানুষগুলো। বিনা স্বার্থে যার যা সামর্থ্য ছিল, যার ঘরে যা রান্না করা খাবার ছিল, তাই দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। বাড়ি থেকে গৃহবধূরা খাবার নিয়ে ট্রেনের কাছে পৌঁছান।
কারো হাতে ছিল ভাত-ডাল, কারো হাতে খিচুড়ি, কারো হাতে রুটি-সবজি, আবার কারো হাতে পানি। এর মাঝেই কেউবা তখন আবার কিছু রান্না করে নিয়ে আসার জন্য উদগ্রীব। বৃদ্ধ এবং শিশুদের প্রতি তাদের নজর ছিল বেশি। তাদের খাবার পানিতে শান্তি পায় সবাই।
ঘটনাস্থল তাঁতীবন্দ গ্রামের বাসিন্দা আবেদ আলী বলেন, ‘আমি যখন দেখলাম স্টেশনের বাইরে হঠাৎ ট্রেনটা অনেক সময় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি অনেকে পানির জন্য, কেউবা খাবারের কষ্ট পাচ্ছে। আশপাশে কোনো দোকানপাট ছিল না। তখন আশপাশের সবাইকে সাধ্যমতো খাবার পানি নিয়ে আসতে বলি। এভাবেই হয়েছে।’
হালিমা খাতুন নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘মানুষের কষ্ট দেখে কি ভাল লাগে কন তো। যেহেনে টেরেন থামিছিল সেহান থেনে কিছুদূর আমারে বাড়ি। মেলাক্ষণ টেরেন দাঁড়া ছিল। মেলা মানুষ। আগা যায়ে দেহি কেউ পানি খুঁজতিছে, কেউ কিছু খাওয়ার তা খুঁজতিছে। তহন বাড়িত যায়া পানি আর ভাত-ডাইল ছিল, সেগুলাই লিয়ে দিছি। আমার নিজেরও ভাল লাগিছে।’
মানিক হোসেন নামের এক ট্রেন যাত্রী বলেন, ‘চিকিৎসার কাজে রাজশাহী যাচ্ছিলাম ওই ট্রেনে। হঠাৎ ইঞ্জিন খারাপ হওয়ায় ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে সকালে বের হয়েছি ট্রেন ধরতে। তারপর বেলা গড়াতে গড়াতে প্রচণ্ড ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় অস্থির লাগা শুরু করে। কিন্তু রেললাইনের আশপাশের মানুষগুলো যেভাবে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিলে তা সত্যি অভূতপূর্ব।’
টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তাদের এমন মানবিক দৃষ্টান্ত আমি কোথাও দেখিনি। ওইসব মানুষগুলোর পরিবার দেখে মনে হয়েছে দিন এনে দিন খাওয়ার মতো। অথচ কিভাবে তারা মানুষের কষ্টে পাশে দাঁড়াল। পাবনার মানুষ যে কতটা আত্মিক আর অতিথি পরায়ন তা আবারো প্রমাণ হলো।