জন্মিলে মৃত্যু হবে এটাই স্বাভাবিক। এ স্বল্প জীবনের নানা প্রবাহে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় আরো অন্যান্য জীবন এবং প্রতিটা সম্পৃক্ততায় সৃষ্টি হয় আবেগ ও ভালোবাসাময় স্মৃতির। এ স্মৃতির টানেই মানুষ কষ্ট পায় প্রিয়জনের হঠাৎ প্রস্থানে কিংবা অকাল প্রয়াণে। মানুষের প্রতি প্রিয়জনের এ টান, এ ভালোবাসা চিরায়ত ও শাশ্বত।
এমনই এক বাস্তবতার মৃত্যু দিয়ে জন্ম দিয়েছিল ৬বছর আগে। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক মহাস্থান দক্ষিণপাড়া গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দীন এর মেয়ে সিমা বেগম। প্রায় ১০ বছর পূর্বে বিয়ে হয় শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা ইউপির আমজানী কুড়িপাড়া গ্রামের মৃত আছতুল্লাহ ফকিরের পুত্র মকবুল হোসেন এর সাথে। বিয়ের পর সাদিক হাসান নামের ১টি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। স্বামী সন্তানদের নিয়ে সুখে শান্তিতেই ছিল সিমা বেগমের সংসার।
কিন্তু সীমাহীন সুখের সময় তাদের পরিবারে নেমে আশে একটি কালবৈশাখী ঝড়। বিয়ের ৪ বছরের মাথায় সীমার স্বামী মকবুল হোসেনের দেহে বাসা বাঁধে ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার। ক্যান্সারে যখন সীমাদের পরিবারে শোকে কাতর সেই মুহূর্তে সীমার সংসারে জন্ম নেয় ২য় পুত্র সিয়াম। এদিকে ক্যান্সারে আক্রান্ত স্বামীর শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে। চোখের সামনে চলে যাচ্ছে তরতাজা স্বামীর প্রাণ। ব্যয় বহুল চিকিৎসা করেও কোন ফলস্বরূপ নেই।
ওই যে বলে ক্যান্সারের নেই কোন অ্যানসার!! সংসারে গরু ছাগল যা ছিল সব শেষ। অবশেষে মকবুল কে মৃত্যুর কাছেই হাড় মানতে হয়। মকবুলের মৃত্যু আর সিমা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রিয়জন হারানোর শোকে। যে গৃহে কোনো মানুষ মারা যায়, সে গৃহে নেমে আসে শোকের মাতম, আহাজারি আর গগনবিদারী আর্তচিৎকার। মৃত্যু অবধারিত, একদিন মৃত্যুর কড়াল গ্রাস সবাইকেই গ্রাস করবে, এতে কেনো সন্দেহ নেই এবং এ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। কিন্তু অকাল মৃত্যু ও অপ্রত্যাশিত মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বড় পুত্র সাদিক হাসান ৪ বছর বয়সে পিতাকে দেখলেও ছোট পুত্র সিয়াম জন্মের প্রায় ৬ মাস পর থেকে কখনো বাবার চেহারাটা দেখেনি। এখন বড় ছেলে সাদিকের বয়স প্রায় (৯) বছর আর সিয়ামের বয়স (৬) বছর। বড় ছেলে সাদিক ৩য় শ্রেণীতে পড়লেও অর্থাভাবে ছোট ছেলে সিয়াম স্কুলে যেতে পারছে না।
তাদের পিতার মৃত্যু একে একে কেটে গেছে যন্ত্রণাময় দীর্ঘ ৬বছর। এতদিনে তারা বুঝতে শিখেছে বাবার আদরের শূন্যতা। এই প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলছিলাম সাদিক ও সিয়ামের সাথে। ২ ভাই খুব চাঞ্চল। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাদের বাবার কথা বলতেই ছলছল করে ওঠে অবুঝ ২শিশুর মায়াবি দুই চোখ। গাল বেয়ে ঝরে ফোঁটা ফোঁটা নোনা জল। তাদের এই বোবা কান্নায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে পিতৃহীন শৈশবের অব্যক্ত গল্প। বড় ভাই সাদিকের কান্না দেখে ছোট ভাই সিয়ামেরও ছলছল চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখের পানি মুছে চাপা কষ্ট লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে দুই ভাই। অর্থাভাবে ভাল খাওয়া, ভাল পড়া, এমনকি ঠিক মত পড়ালেখাও হচ্ছে না। জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তারা। মা, সিমা বেগম একটি বিধবা ভাতার জন্য কৃষক পিতা জালাল উদ্দীন কে নিয়ে জনপ্রতিনিধি সহ অনেক মহলে যোগাযোগ করলেও আজও জোটেনি একটি বিধবা ভাতার কার্ড।
বরং মোকাতলার এক টাউট বাটপার বিধবা ভাতার কার্ড দেওয়ার নামে সিমার কষ্টের ১ হাজার টাকা নিয়েছে। সিমার পিতা জালাল উদ্দীন ওই বাটপারকে ফোন দিলে পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখে। সিমার পিতা জালাল উদ্দীন বলেন, আমার বাড়ি ছাড়া দামি কোন সম্পাদক নেই।
কৃষিকাজ করে যা উপার্জন করি তা দিয়ে নিজে চলি ও মেয়ে আর নাতিদের দেখভাল করি। খুবই চিন্তা হয় জীবনের শেষ সময়ে এসে যদি নাতিদের জন্য কিছু করে যেতে পারতাম তাহলে মরলেও শান্তি পেতাম। তাই শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম সম্পা উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ রিজু ও মোকামতলা ইউপির নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান আহসান হাবীব সবুজকে একটি বিধবা ভাতা কার্ডের জন্য পরিবারটি আকুল আবেদন জানিয়েছেন।। সেই সাথে সরকারি অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সহযোগিতাও চেয়েছেন।