জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদর্শিতা গুণে দেশ গঠনের নানা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতির পাশাপাশি শিল্প ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসেও শেখ মুজিবুর রহমান অনন্য এক নাম। চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাঁকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্র নিয়েই আজকের আলোচনা।
বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পের সূচনালগ্নে বঙ্গবন্ধু…
পঞ্চাশের দশক, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ, নিপিড়ন ও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। সেসময় পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র নির্মানের কোনো সুযোগ ছিলো না। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্ভাসিত মুক্তধারার কোনো বাঙালির চলচ্চিত্র নির্মান যাত্রা ছিলো নেহাতই কঠিন ব্যাপার। পশ্চিম পাকিস্তানে কোটি টাকা ব্যয়ে সেসময় গড়ে উঠেছিল “ফিল্ম স্টুডিও”, তাই ফিল্মের নেগেটিভ নিয়ে যেতে হতো পশ্চিমের লাহোরে। আবার প্রক্রিকরন শেষে আনতে গেলেও দিতে হতো কাস্টম ক্লিয়ারেন্স। ফলস্বরূপ পূর্ব বাংলায় একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্টুডিও নির্মানের দাবি ক্রমেই জোরদার হতে থাকে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে, শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প, বানিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহন করেন। এ সময় ঢাকায় একটি স্থায়ী ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন আবদুল জব্বার খান (বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাতা),নাজির আহমেদ (প্রাদেশিক ফিল্ম বিভাগের প্রধান), ড: আবদুস সাদেক, নূরুজ্জামান প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দেন এবং একটি পরিকল্পনা পেশ করতে বললেন। এবং তারা একটি পরিকল্পনা পেশ করেন যা বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ২৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পেশ করেন। এবং ৩ এপ্রিল ১৯৫৭, উক্ত বিলটি কিছু সংশোধনীকরনের মাধ্যমে বিনা বাধায় আইন পরিষদে পাশ হয়। ১৯ জুন ১৯৫৭ থেকে আইনটি কার্যকর হয়। এবং ” পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা ” যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে যা “বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা” (বিএফডিসি) নামে পরিচিত। ২০১২ সাল থেকে এই ৩ এপ্রিল জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়কালে চলচ্চিত্র যাত্রা ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা…
১৯৫৭ সালে “পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা” নির্মাণের পর ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পায় নি! সে সময় বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বেশকিছু গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেন। এসব সিদ্ধান্তের ফলে দ্রুত চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ হয় এবং নতুন নতুন প্রযোজক, পরিচালক ও কলাকুশলীরা এ পেশায় যোগ দিতে থাকে। ১৯৫৯ সালে আখতার জং কারদার “জাগো হুয়া সাভেরা” চলচ্চিত্রটি নির্মাণের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার থমকে যাওয়া চলচ্চিত্র শিল্পকে সচল করে। যদিও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ চলচ্চিত্রটি পুরষ্কৃত ও আলোচিত হলেও ব্যবসা সফল হয় নি। একই বছর মুক্তি পায় এহতেশাম পরিচালিত “এ দেশ তোমার আমার”,ফতেহ লোহানীর “আকাশ আর মাটি” এবং মহিউদ্দিনের “মাটির পাহাড়”। ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ফতেহ লোহানীর “আসিয়া” এহতেশামের “রাজধানীর বুকে”। ষাটের দশকে মুক্তি পায় আরো কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র -সালাহ্উদ্দিনের যে নদী মরূপথে (১৯৬১), সূর্যস্নান (১৯৬২) ও ধারাপাত (১৯৬৩)। জহির রায়হান নির্মাণ করেন যে নদী মরুপথে ও কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২, কলিম শরাফী সহযোগে), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫)। এরই মাঝে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীত্বকালে ১৯৬৩ সালে জারি হয় The Censorship of film act, 1963। এর পরেও নির্মাণ হয় ” আনোয়ারা” (১৯৬৭) ও “জীবন থেকে নেয়া” (১৯৭০) এর মতো সাহসী চলচ্চিত্র।
স্বাধীনতা পরবর্তী চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র শিল্পের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধু….
৯ মাস সশস্ত্র যুুদ্ধের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। যুদ্ধে বিদ্ধস্ত এই দেশের পুনঃগঠনের দ্বায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বানিজ্য, শিল্প ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে তিনি দ্রুত কাজ শুরু করেন। তৈরি করেন প্রথম “পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ” । এই পরিকল্পনায় চলচ্চিত্র খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ৪ কোটি ১০ হাজার টাকা। বরাদ্দকৃত এ অর্থে ফিল্ম স্টুডিওর সম্প্রসারণ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে নতুন ফিল্ম স্টুডিও প্রতিষ্ঠা, ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও সারা দেশে ১০০টি নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হবে ছয় হাজার লোকের কর্মসংস্থানের। এ সময় বাড়তে থাকে চলচ্চিত্রের সংখ্যা। নির্মিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার চলচ্চিত্র। অন্যদিকে পুনর্গঠিত হয় এফডিসি, সেন্সর বোর্ড, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, সংযোজিত হয় সেন্সর নীতিমালা। একই সঙ্গে প্রচেষ্টা চলে ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার। বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্র পছন্দও করতেন বলে জানা যা, আর মুক্তমনা ও দূরদর্শী মানুষ ছিলেন বলেই চলচ্চিত্র উন্নয়নে এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গুলো নিয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালকেরাও । চলচ্চিত্র, শিল্প-সাহিত্যের নানা অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণও করতেন।
বঙ্গবন্ধু ও সত্যজিৎ রায়।
স্বাধীনতার পর অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় এই বাংলার মাটিতে। উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৭২ সালে আলমগীর কবিরের “ধীরে বহে মেঘনা”, জহিরুল হকের “রংবাজ”, সুভাষ দত্তের “বলাকা মন”, ঋত্বিক ঘটকের “তিতাস একটি নদীর নাম”। এই চলচ্চিত্র গুলো বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশেষ মানে উন্নীত করে। এই সুস্থ ও সৃজনশীল ধারায় ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয় নারায়ণ ঘোষ মিতার “আলোর মিছিল”। ১৯৭৫ সালে নারায়ণ ঘোষ “মিতার লাঠিয়াল”। এভাবেই আরো অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র বাংলার মাটিতে তৈরি হতে থাকে।
চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু…..
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় বেশকিছু প্রামাণ্যচিত্র। ১৯৭৩ সালে জাপানের নাগাসি ওশিমা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি জীবন, প্রত্যাহিক কর্মকান্ড ও পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কিত প্রামাণ্যচিত্র ” রহমান, দ্যা ফাদার অফ বেঙ্গল”। যুক্তরাজ্যের ডেভিড ফ্রস্ট নির্মাণ করেন সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র “বাংলাদেশ”। ফাখরুল আরেফীন খান নির্মাণ করেন ৭ই মার্চের ভাষনের বিশ্লেষনাত্মক প্রামাণ্যচিত্র ” দ্যা স্পিচ”। আব্দুল গাফফার চৌধুরী নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচিত্র “পলাশি থেকে ধানমন্ডি”। এমন আরোকিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে।
একটি চমকপ্রদ ব্যপার হলো বঙ্গবন্ধু একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ” সংগ্রাম” চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের শেষ দিকে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্যালুট করছে। সেই দৃশ্যে বঙ্গবন্ধুকেই অভিনয় করার জন্য অনুরোধ করেন চিত্রনায়ক কামরুল আলম খান খসরু ও চাষি নজরুল ইসলাম। প্রথমে রাজি না হলেও পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নানকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে অভিনয়ের জন্য বঙ্গবন্ধুকে রাজি করান কামরুল আলম খান খসরু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির প্রাথমিক নাম রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু। এটি নির্মাণ করছেন ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। চলচ্চিত্রটির শিল্পি নির্বাচনের কাজও প্রায় শেষ।
তরুণ প্রজন্মের বঙ্গবন্ধু….
তরুণ প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর সাহসীকতা, দূরদর্শিতা, চিন্তা ও মননশীলতা তরুণ নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে। ১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্র কর্মীদের সাথে সাক্ষাৎকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন -“এই বাংলাদেশকে আমি বড়ই ভালোবাসি।
তোদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ! আমার সোনার বাংলা! তোরা যদি পারিস – “এই সোনার বাংলাদেশকে নিয়ে সোনার বাংলা ছবি তৈরি করিস”।
তাঁর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলতে চাই, আমরা – তরুণেরা এই সোনার বাংলায় স্বপ্ন দেখি চলচ্চিত্র নির্মানের। ” আমাদের স্বপ্নের সিনেমা”।
লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম এ্যান্ড টেলিভিশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন