ক্যাপসাইসিন হলো মরিচে থাকা একটি মিশ্র পদার্থ যা গরম বা ঝালের অনুভূতি দেয়। ফলে আমরা যখন মরিচ খাই তখন আমাদের ঝাল বা জ্বলন্ত স্বাদ লাগে। এটি কাপসাইসিন ক্যাপসাইসিনয়েড নামক যৌগের একটি অংশ।
মরিচের ঝাল বা অত্যধিক পরিমাণ ক্যাপসাইসিনের উপস্থিতি থাকায় ইউরোপের কিছু দেশে মশলাদার রামেন নুডলস নিষিদ্ধ করার ঘটনাও ঘটে।এরপরই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আসলেই কি মরিচ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ?
মরিচের মধ্যে প্রায় ২৩টি ভিন্ন ভিন্ন ক্যাপসাইসিনয়েড পাওয়া গেছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো ক্যাপসাইসিন।
যুক্তরাজ্যের ফুড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি খাদ্য উৎপাদকদের খাবারে খাঁটি ক্যাপসাইসিন যুক্ত করতে অনুমতি দেয় না। কেননা, দেশটির খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাঁটি ক্যাপসাইসিনকে অনিরাপদ বলে মনে করে।কিন্তু মরিচের নির্যাসে প্রাকৃতিকভাবে ক্যাপসাইসিন উপস্থিত থাকলে সেটি কতখানি ব্যবহার করা যাবে তা নির্ধারিত করে দেয়নি দেশটির খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
ফেডারেল ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট ইন জার্মানি’র একজন মুখপাত্র বলেছেন, “ক্যাপসাইসিনয়েডের ডোজ কার জন্য কতখানি গ্রহণে কী প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য না থাকায় স্বাস্থ্য বিধিনিষেধসহ ভোক্তাদের জন্য কোনও সুপারিশ করা যায় না।”
তবে মানুষের উপর চালানো গবেষণার তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিএফআর বলছে, এটি অনুমান করা যেতে পারে যে শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে এক মিলিগ্রাম বা তার বেশি ক্যাপসাইসিনয়েড গ্রহণের ফলে হালকা অস্বস্তিকর প্রভাব হতে পারে, যেমন জ্বরের অনুভূতি, পেট বা বুক জ্বালা।
এটি ১৭০ মিলিগ্রাম পরিমাণ খেলে মানুষের শরীরে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।প্রায় ৬০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসাইসিনয়েড খাওয়ার পর রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একটি ঘটনাও বিফআর নথিভুক্ত করেছে।
জার্মানির বার্লিনে মরিচ খাওয়ার এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ২৭ বছর বয়সী একজন ব্যক্তি চারটি ভুট জোলোকিয়া বা নাগা মরিচ এবং অন্যান্য মশলাদার খাবার খেয়েছিলেন। ভুট জোলোকিয়া বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচের জাত হিসেবে বিবেচিত।
ওই মরিচ খাওয়ার আড়াই ঘণ্টা পরে সেই ব্যক্তির পেটে ব্যথাসহ প্রচণ্ড পেট ফোলা শুরু হয়। পরে তাকে বার্লিনের হেলিওস হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়।
রিপোর্টে ডাক্তাররা অন্য কোনও সমস্যা খুঁজে পান নি, ফলে শুধু ব্যথার কারণে কিছু ব্যথানাশক ওষুধ দিয়েছিলেন। মরিচ খাওয়ার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর লোকটি বমি করলে আস্তে আস্তে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে।
তবে এ ধরনের উপসর্গ যে শুধুমাত্র ক্যাপসাইসিন খাওয়ার ফলেই হতে পারে তা কিন্তু নয়। অস্ট্রেলিয়ার বন্ড ইউনিভার্সিটির ওষুধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান মোরো বলেছেন, “ক্যাপসাইসিন খুব অল্প সময়ের জন্য জ্বালাপোড়া তৈরি, অস্বস্তি ও ব্যথার কারণ হতে পারে। যদি এটি কারও চোখে পড়ে, তখন সত্যিই তীব্র জ্বালাপোড়া হতে পারে এবং দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিতে পারে। আবার শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে দীর্ঘক্ষণ কাশি হতে পারে। এটি হাঁপানির মতো অসুস্থতাকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে।”
অধ্যাপক মোরো এটাও বলেছেন, “ক্যাপসাইসিন খাওয়ার ফলে যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে তা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ক্যাপসাইসিন আমাদের স্নায়ুকে সক্রিয় করে এবং সাময়িক জ্বালাপোড়া তৈরি করতে পারে, এটি কেবল একটি সংবেদন তৈরি করে, এটি আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি করে না।
অন্যান্য অনেক খাবার ও পানীয়ের মতোই একজন ব্যক্তির শরীরে ক্যাপসাইসিনের প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রম বা আইবিএস (পেটের নানা সমস্যাজনিত ব্যাধি) আছে তাদের জন্য ক্যাপসাইসিন বেশ পীড়াদায়ক। কিন্তু সুস্থ মানুষদের জন্য নয়।
গবেষকরা আইবিএস আক্রান্ত ২০ জন এবং আইবিএস ছাড়া ৩৮ জন সুস্থ মানুষের শরীরে এক ধরনের গবেষণা চালান। এ সময় তাদেরকে দুই গ্রাম মরিচের একটি ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়।
এতে দেখা যায়, আইবিএস আক্রান্ত নন এমন ব্যক্তিদের পেটে হালকা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। কিন্তু যারা আইবিএস আক্রান্ত তাদের পেটে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া লক্ষ্য করা গেছে মাত্রাতিরিক্ত।
এছাড়াও, রিফ্লাক্স ডিজিজের মতো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনালের সমস্যা আক্রান্তরা ক্যাপসাইসিনয়েড গ্রহণের ফলে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বিএফআর বলছে, ক্যাপসাইসিন কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
নিউ মেক্সিকোতে উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক পল বোসল্যান্ড বলেছেন, “প্রত্যেক মানুষের ক্যাপসাইসিনয়েডের সহনশীলতার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। একজনের কাছে যা অত্যন্ত ঝাল মনে হতে পারে আরেকজনের কাছে মাঝারি বলে মনে হতে পারে।”।
তাইওয়ানের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ক্যাপসাইসিন গ্রহণের ফলে বুক জ্বালা অসুখের লক্ষণগুলো কমতে পারে। কারণ তখন এটিতে শরীরও অভ্যস্ত হয়ে যায়।
বোসল্যান্ড বলেন, একবার আমার কাছে মরিচ নিয়ে কাজ করা দুইজন বিজ্ঞানী এসেছিলেন। তাদের একজন চীন থেকে এবং অন্যজন ভারত থেকে। তারা আমার পরীক্ষাগারে গিয়েছিলেন। আমি তাদের দুপুরের খাবারে নিয়ে গেলাম, এবং যখন আমরা আমাদের এনচিলাডাস খেয়েছিলাম, চীনের বিজ্ঞানী বলেছিলেন যে তিনি যখন ভারতে গিয়েছিলেন তখন সেখানে এই খাবারটি চীনের চেয়ে বেশি ঝাল বলে মনে হয়েছিল। ভারতের বিজ্ঞানী বলেছেন, ‘আমি যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন আমার একই রকম ঝাল মনে হয়েছে।
যদিও দুইজন বিজ্ঞানীই মশলাদার খাবারের জন্য পরিচিত দেশগুলো থেকেই এসেছেন। কিন্তু তারা উভয়েই ভেবেছিলেন অন্যদের খাবারে ঝাল বেশি, বলেন বোসল্যান্ড।
ইতিহাস বলছে, স্বাস্থ্য প্রতিকারের জন্য মরিচ ব্যবহৃত হয়েছে, এবং আধুনিক ওষুধ তৈরিতেও ক্যাপসাইসিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মরিচের নির্যাস ব্যথা উপশম, মাইগ্রেন, মাথা ব্যথাসহ অনেক রোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এমনকি গ্যাস্ট্রিক ও ক্যান্সার প্রতিরোধে ক্যাপসাইসিন ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়ে থাকেন গবেষকরা।
গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ, বিপাক তন্ত্রের সমস্যা, স্থূলতাসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে ক্যাপসাইসিন খুবই উপকারী। কখনও কখনও গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণের কারণে ক্যাপসাইসিন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার প্রমাণও রয়েছে। কারণ এটি গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধ ও নিরাময় করতে সহায়তা করতে পারে।
অধ্যাপক মোরো বলেছেন, খাবারে লবণের চেয়ে মরিচ খাওয়া ভালো। তাই লবণের চমৎকার একটি বিকল্প হতে পারে মরিচ। যদিও উচ্চ মাত্রার ক্যাপসাইসিন খেলে কিছু মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে, তবে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে অতিরিক্ত মরিচ বা কাপসাইসিন খাওয়ার ফলে ঝালের অনুভূতি ছাড়া অন্য কোনো কঠিন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।