English

15 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
- Advertisement -

একটি পোকা দিয়ে কীভাবে জানা গিয়েছিল মানব দেহকোষের রহস্য

- Advertisements -

১৯৫০ এর দশকে ডিএনএ’র গঠন আবিষ্কৃত হবার পর দক্ষিণ আফ্রিকান জীববিজ্ঞানী সিডনি ব্রেনার এমন একটা প্রাণী খুঁজছিলেন- যা তাকে মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক আচরণের পেছনে যে জীনগুলো কাজ করে তা চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে।

তিনি বেছে নিয়েছিলেন একটি ক্ষুদে নেমাটোড বা পরজীবী কৃমিজাতীয় পোকা যার নাম সাইনোহাবডাইটিস এলিগ্যান্স – সংক্ষেপে সি এলিগ্যান।

এর গায়ের চামড়া একেবারে স্বচ্ছ- তাই একে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে জীবিত অবস্থাতেই তার দেহকোষগুলো কীভাবে কাজ করে তার প্রক্রিয়া সরাসরি দেখা সম্ভব।

এরপর থেকে মানুষের দেহ কীভাবে কাজ করে তার সম্পর্কে বহু রকমের আবিষ্কারের কেন্দ্রে ছিল এই পোকাটি।

জীববিজ্ঞানকে বাস্তবে ঘটতে দেখা

সিডনি ব্রেনার বলেছিলেন, “আমার দরকার ছিল এমন একটি প্রাণী- যার ওপর আমি জেনেটিকসের আসল গবেষণাগুলো করতে পারব। এ প্রাণীটিকে হতে হবে ক্ষুদ্র- যাকে আমি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে বসাতে পারব। বেশ কিছু প্রাণীর কথা আমি ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত বেছে নিলাম নেমাটোড জাতীয় পোকা । শুরু করে দিলাম কাজ।”

গর্ডন লিস্কো হচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়ায় মানুষের বার্ধক্য বিষয়ে গবেষণার জন্য যে বাক ইনস্টিটিউট- তার ভাইস প্রেসিডেন্ট।

তিনি বলছেন, পোকাদের জগতে সিডনি ব্রেনার ছিলেন ঈশ্বরের মত। খুব জটিল জীববৈজ্ঞানিক কাজের জন্য খুব সরল একটি প্রাণী বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

“এটা ছিল একজন প্রতিভাবানের কাজ, খুব বিচক্ষণ এক নির্বাচন। এই পোকার মধ্যে যা আছে তাকে বলা যায় মৌলিক জীববিজ্ঞান, কিন্তু সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হল একে কীভাবে মানুষের রোগব্যাধিগুলোর প্রকৃতিকে বোঝার জন্য কাজে লাগানো হয়েছে।”

“সি এলিগ্যানের একটা বিরাট সুবিধা ছিল যে এটা স্বচ্ছ। কাজেই মাইক্রোস্কোপ দিয়ে আপনি প্রাণীটার কোষগুলো দেখতে পাচ্ছেন, জীববিজ্ঞানকে বাস্তবে ঘটতে দেখছেন। পোকাটা মাত্র এক মিলিমিটার লম্বা। কাজেই আপনি ল্যাবরেটরিতে হাজার হাজার পোকা উৎপাদন করতে পারছেন। তাই এটা দুর্লভ জিন বা এরকম কিছু পরীক্ষা করার জন্য একটা বড় সুবিধা।”

লিস্কো বলছেন, “সিডনি ব্রেনারের প্রতিভা এখানেই যে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন- মানুষের মস্তিষ্কে শত শত বা লাখ লাখ কোটি সেল আছে, কিন্তু এই পোকাটার মধ্যে আছে মাত্র ৩০২টি নিউরন। তার ওপর এগুলোকে আপনি মাইক্রোস্কোপের ভেতর দিযে দেখতে পাচ্ছেন।”

মানব জিনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স

বব ওয়াটারস্টোন হচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের জিনোম সায়েন্সের অধ্যাপক। তিনি ১৯৮০ এর দশকে যুক্তরাজ্যে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ড, ব্রেনারের ল্যাবরেটরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

বব ওয়াটারস্টোন বলছেন, “একটা প্রাণী বা অর্গ্যানিজম হিসেবে এই সি, এলিগ্যান্স সত্যি দুর্দান্ত। এর অনেক কারণ আছে। যেমন- পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় এর দেহকোষের সংখ্যা ১ হাজারেরও কম। আমরা জানি যে এই কোষগুলো কী, এরা কী কাজ করে। তার ওপর এটা খুবই ছোট । ফলে আপনি অনেকগুলো পোকা পরীক্ষা করতে পারেন, যেটা জেনেটিকসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিডনি বলতেন, এর ফলে আপনি অনেক বিরল জেনেটিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পারেন- যা একটা রাইনো বা গণ্ডারের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।”

মানব জিনোম প্রকল্পে তার কাজের জন্য বব ওয়াটারস্টোন বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু সেই বিরাট কাজের প্রস্তুতি হিসেবে- তিনি একটি ছোট দলের অংশ হয়েছিলেন যাদের কাজ ছিল সি এলিগ্যানের জিনোম মানচিত্র তৈরি করা। এটিই হচ্ছে প্রথম প্রাণী যার জিনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স তৈরি হযেছিল।

ওয়াটারস্টোন বলছেন, “সে সময় এ নিয়ে অনেক সংশয় ছিল- যে এই সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স তৈরি করে আসলে কোনও লাভ হবে কিনা। কেউ কেউ মনে করতো, এর খরচ অনেক, এটা না করাই ভাল। বরং একক জিন অনুসন্ধান করাটাই দরকারি কাজ হবে। আরেকটা সমস্যা ছিল কিভাবে এটা করতে হবে তা কেউ জানতো না।”

“আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলাম যে তখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে সি এলিগ্যানের মত একটা ক্ষুদ্র প্রাণীর জিনোম সিকোয়েন্স তৈরি করা যায় কিনা। তারপর সেটাকে সম্প্রসারিত করে হয়তো পূর্ণ মানব জিনোমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।”

এখন আমরা জানি যে- এই চিন্তা পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। এ নিয়ে প্রথমে যে সংশয় ছিল তা কেটে গেল সি এলিগ্যানের জিনোম সিকোয়েন্স তৈরির পর।

দেখা গেল- এটা এত রকমের কাজে লেগে যাচ্ছে যা আগে কেউ কল্পনাই করেননি, বলছিলেন গর্ডন লিস্কো।

“মৌলিক জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকে- সি এলিগ্যান্সের সাথে আসলে মানুষের অনেক মিল আছে। সিকোয়েন্স করার পর আমরা দেখলাম- যেসব মানুষের বিভিন্ন রোগব্যাধির সাথে যেসব জিন সংশ্লিষ্ট- তার দুই-তৃতীয়াংশই সি এলিগ্যান্সের মধ্যে আছে। সেকারণে মানুষের রোগ সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা আপনি এই পোকাটি দিয়েই করতে পারছেন।”

প্রাণীর আয়ু, বার্ধক্য আর ক্যান্সারের মত রোগ

১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে বিজ্ঞানীরা মিউট্যান্ট পোকা নিয়ে কাজ করছিলেন- তারা দৈবক্রমে আবিষ্কার করলেন যে সি এলিগ্যানের একটিমাত্র জিনের মিউটেশনের ফলে পোকাটির জীবনকাল ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।

পাঁচ বছর পরে এই পোকাটি সংবাদপত্রের শিরোনামে পরিণত হল। কারণ তখন আরেকটি জিনের মিউটেশন খুঁজে পাওয়া গেল- যার কারণে সি এলিগ্যানের জীবনকাল ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। শুধু তাই নয় পোকাটি তার জীবনের শেষ পর্যন্ত সুস্থসবল ছিল বলেও দেখা গেল।

লিস্কো বলছেন, “আমরা মনে করেছিলাম মানুষের জীবনকাল মোটামুটি নির্দিষ্ট। কিন্তু এই পোকাটিকে পরীক্ষা করে আমরা দেখলাম যে একটা প্রাণীর জীবনকাল বা আয়ু জিনিসটাকে আসলে পরিবর্তন করা সম্ভব। একে দশগুণ বাড়ানো যায়- যা প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার। এবং ব্যাপারটাকে যদি আণবিক স্তরে বা কোষের স্তরে বিবেচনা করেন- তাহলে দেখা যায়, এই যে পোকার আয়ু ১০-২০ গুণ বাড়ানোর প্রক্রিয়া- তার সাথে মানুষের বার্ধক্যের প্রক্রিয়ার অনেক মিল আছে।”

“এটা শুধু বার্ধক্যের বিষয় নয়, যেসব রোগ এই বার্ধক্য ডেকে আনে- তার ব্যাপারও বটে। পোকার মধ্যে আমরা যে প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করছি, সেটাই হয়তো মানুষের ক্ষেত্রে আলঝেইমার্স, ক্যান্সার, অস্টিওপোরোসিস, বা পার্কিনসন্স-এর মত রোগের চালিকাশক্তি বা এমনকি হয়তো কারণও হতে পারে।”

লিস্কো বলছিলেন, “এইজিং বা বুড়িয়ে যাওয়া ব্যাপারটিকে আমরা যেভাবে দেখতাম, বা মানুষের আয়ু জিনিসটাকে যেভাবে দেখতাম- এই পোকাটি সেটা বদলে দিয়েছে। এর সঙ্গে রোগের যে সম্পর্ক- তাও বদলে যাচ্ছে।”

সি এলিগ্যন পরীক্ষা থেকে যে এত কিছু জানা যাচ্ছিল- তাতে সিডনি ব্রেনার নিজেও অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, এটা বিস্ময়কর যে একেবারে নতুন একটা ক্ষেত্র এখন এত বিশাল ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

সি এলিগ্যানের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে সিডনি ব্রেনার-সহ একাধিক বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

দেহকোষের “আত্মহত্যা”

দেহের কোষও যে আত্মহত্যা করে- তা আবিষ্কার করেই সিডনি ব্রেনার এবং তার আরও দুজন সহকর্মী ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

সেল সুইসাইড বা দেহকোষের আত্মহত্যার প্রক্রিয়াটি ঘটে – মাতৃগর্ভে থাকার সময় মানুষের দেহের আকৃতি গঠনের সময়। যখন তার হাত ও পায়ের আঙুল, দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়।

এর ব্যাখ্যা করে বব ওয়াটারস্টোন বলছিলেন, “দেহকোষের আত্মহত্যা হচ্ছে একটা জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। যে দেহকোষগুলো প্রয়োজনীয় নয়- সেগুলো প্রোগ্রামের মত আগে থেকেই নির্থারিত থাকে। প্রোগ্রাম সক্রিয় হয়ে উঠে কোষটাকে মেরে ফেলে।”

“এটা খুবই প্রয়োজনীয় একটা প্রক্রিয়া। যদি কোষের মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ না করে, যদি দেহকোষের আত্মহত্যার প্রক্রিয়াটি কার্যকর হয়ে উঠতে না পারে- তাহলে আপনার দেহে কয়েক রকমের ক্যান্সার হতে পারে। এসব গবেষণায় সি এলিগ্যান একের পর এক অবদান রেখেছে।”

“জিন কীভাবে কাজ করে তা আমরা সি এলিগ্যানের ভেতর দিয়ে অনেক দ্রুতগতিতে জানতে পেরেছি- মানবদেহকোষের মাধমে যা জানতে অনেক সময় লাগত।”

২০০৬ সালে সি এলিগ্যান নিয়ে কাজ করে আরও দুজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পান।

এমনকি মহাশূন্যের চরম পরিবেশের মধ্যে দেহকোষ কীভাবে কাজ করে তা জানার ক্ষেত্রেও সি এলিগ্যান ব্যবহৃত হয়েছে।

লিস্কো বলছেন, “মহাশূন্যে স্পেস শাটলের মধ্যেও জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালাতে সি এলিগ্যান ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে মহাশূন্যে তা প্রজনন এবং বংশবৃদ্ধি করতেও সক্ষম হয়েছে।”

২০০৩ সালের ফেব্রয়ারিতে স্পেস শাটল কলম্বিয়া পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। নভোচারীদের সবাই নিহত হন। কিন্তু বেঁচে ছিল সি এলিগ্যানগুলো।

গর্ডন লিস্কোবলছিলেণ, “বিস্ফোরণের পর সি এলিগ্যান ভর্তি পাত্রগুলোর কয়েকটি মাটিতে খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়, পোকাগুলো জীবিত আছে। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার যে ওই বিস্ফোরণের পরও তারা টিকে থাকতে পেরেছে।”

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ

আল কোরআন ও আল হাদিস

- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন