বজ্রপাতের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে ঝড়-বৃষ্টির সময় এর সম্ভাবনা থাকে শতভাগ। এপ্রিল থেকে জুন বা বাংলা মাস চৈত্র থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত বজ্রপাত বেশি হয়। বজ্রপাতে প্রাণহানীর আশঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়েই চলেছে।
বজ্রপাত বলতে আকাশের আলোর ঝলকানিকে বোঝায়। আভিধানিক ভাষায় বলতে গেলে, এসময় উক্ত এলাকার বাতাসের প্রসারন এবং সংকোচনের ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে। বজ্রপাতে ডিসি কারেন্ট তৈরি হয়।
জানেন কি? বজ্রপাতের সময় যে ফ্ল্যাশ বা আলোর ঝলকানি দেখতে পান, তার ভোল্টেজ কত? জানলে অবাক হবেন বৈকি! একটি সাধারণ বজ্রপাতের ফ্ল্যাশ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ভোল্ট এবং প্রায় ৩০,০০০ এম্পিয়ার এর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। যেখানে সাধারণ বাসাবাড়িতে ২২০ ভোল্ট এর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বজ্রপাতের ফলে এক বিশাল পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। মেঘ থেকে ভূমিতে হওয়া একটি সাধারণ বজ্রপাতে প্রায় ১ বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন হয়। বজ্রপাতে যেহেতু প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ ভূগর্ভে চলে যায় সেহেতু এর প্রভাবে ভূগর্ভে অনেক মূলবান পদার্থের খনি বা আকড় হওয়ার সম্ভবনাকে কমিয়ে দেয়।
আরেকটি বিষয় হয়তো খেয়াল করেছেন বজ্রপাতের সময় আগে আলো এবং পরে শব্দ শোনা যায়। এর কারণ কি জানেন? এর মূল কারণ হলো আলো এবং শব্দের বেগের পার্থক্য। আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
আমরা জানি আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার (প্রতি সেকেন্ডে ৩ ×১০ ^ ৮ মিটার)। অন্যদিকে ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শব্দের গতি প্রতি সেকেন্ডে ৩৩২ মিটার। গতির এই পার্থক্যের কারণে বজ্রপাতের শব্দ বিদ্যুৎ চমকানোর একটু পরে শোনা যায়।
মেঘের মধ্যে যে নেগেটিভ ও পজিটিভ চার্জ থাকে তা যদি যুক্ত হয়, তখন তা মেঘের মধ্যে আলো বা স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। এটাকে আমরা মেঘের মধ্যে আলোর ঝলক হিসেবে দেখি। যেখানে মেঘের মধ্যে আলো সৃষ্টি হয় সেখানকার বায়ু প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে থাকে। ডিসচার্জ হওয়ার সময়ই বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় এয়ার ব্রেকডাউন।
বাতাসের মধ্যে যে চ্যানেলের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। যার তাপমাত্রা ২৭০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে উন্নিত হয়, তা সূর্যের তাপমাত্রার ছয়গুণ বেশি এবং বাতাসের স্বাভাবিক চাপ থেকে প্রায় ১০ থেকে ১০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই চাপ ও তাপমাত্রায় পৌঁছাতে সময় লাগে এক সেকেন্ডের কয়েক হাজার গুণের এক ভাগ।
বজ্রপাত অনেক ধরনের হয়। তবে আমাদের দেশে মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে
১. ক্লাউড লাইটেনিং: যখন কোনো মেঘ নিজেদের মধ্যে চার্জ বিনিময় করে, তখন যে বজ্রপাত সৃষ্টি হয় তা ক্লাউড লাইটেনিং। এ ধরনের বজ্রপাত খুব সামান্য পরিমাণ ভোল্টেজ তৈরি করে। আওয়াজ করে না।
২. ক্লাউড টু লাইটেনিং: এ ধরনের বজ্রপাতে বড় মেঘ উপরে থাকে এবং নিচে ছোট মেঘ থাকে। ফলে বড় মেঘ ছোট মেঘের উপর নিচের চার্জকে ডিসচার্জ করে দেয়। একে আমরা ক্লাউড টু লাইটেনিং বলি। এ ধরনের বজ্রপাতে আলো ও শব্দ দু-ই সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৩. ক্লাউড টু গ্রাউন্ড লাইটেনিং: এ ধরনের বজ্রপাতে মেঘের নিচের দিকে ভারী নেগেটিভ চার্জ জমা হতে থাকে। মেঘের মধ্যে এ ধরনের চার্জের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে বৃহৎ আকারে পরিণত হয়। ফলস্বরূপ, মেঘ শক্তিশালী ধারকে পরিণত হয়। ধারক চার্জ সঞ্চয় রাখে। এ সময় তড়িৎ আবেশ প্রক্রিয়ায় তার বিপরীতধর্মী চার্জ অর্থাৎ পজিটিভ চার্জ ভূপৃষ্ঠে তৈরি হয়।
এছাড়া বল লাইটনিং হয়, যেটা হল একটি নীল-সাদা বা হলুদ বিদ্যুতায়িত গোলক যা বাতাসে বা মাটি বরাবর ভেসে থাকে। এটি সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। আরেকটি আছে ইন্ট্রা-লাইটিং ক্লাউড। আন্তঃ-মেঘ বজ্রপাত ঘটে যখন কারেন্ট একই মেঘের মধ্যে ভ্রমণ করে কারণ এটি বিভিন্ন চার্জের অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করে, যার ফলে একই মেঘের বিভিন্ন অংশ আলোকিত হয়।