দেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্য পুরুষের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ২২ ও নারীদের সংখ্যা ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি হচ্ছেন। পুরুষরা বেশি শিকার হচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিং ও এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ে।
শনিবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২২’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছে প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সাইবার প্যারাডাইজ লিমিটেড। সিসিএ ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপতিত্বে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন গবেষক দলের প্রধান ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মনিরা নাজমী জাহান।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস পরবর্তীসময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার বাড়ছে। ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর, এই হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। হয়রানির শিকারের পর ভুক্তভোগীদের ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশই আইনের আশ্রয় নেয় না। এছাড়া আইনের আশ্রয় নেওয়া ভুক্তভোগীদের মাত্র ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ আইনি সেবার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকলজ্জার ভয়সহ বিভিন্ন কারণে অপরাধের বিষয়ে ভুক্তভোগীরা কোথাও অভিযোগ করেন না। সার্বিক পরিস্থিতিতে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ আটটি সুপারিশ তুলে ধরা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
জরিপে ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগী ১৯৯ জনকে ১৮টি প্রশ্ন করা হয়। সেই মতামতের ভিত্তিতে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
কাজী মুস্তাফিজ বলেন, গবেষণায় সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন। তারা কোথাও প্রতিকার না পেয়ে সিসিএ ফাউন্ডেশনের কাছে সহায়তা চান। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আর বেশি কিছু করার থাকে না। মূলত সাইবার অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই সচেতন হওয়া জরুরি।
আলোচকদের মধ্যে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির পরিচালক সাকিফ আহমেদ বলেন, দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেশিরভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ভুক্তভোগী। শিশুদের পরিস্থিতি আরও আশঙ্কাজনক। একটা ইন্টারনেট সংযোগ একই সময়ে পরিবারের ১৩-১৪ জন্য ব্যক্তি ব্যবহার করেন। কিন্তু সবাই ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন নন। এ ধরনের অপরাধ থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। দেশে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার অবৈধ ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীদের আইডি লগ সংরক্ষণ করে না, এটি জরুরি।
সাবেক অডিটর জেনারেল ও প্রযুক্তিবিদদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা শুধু ভুক্তভোগীই নয়, অপরাধীরাও বেশিরভাগ এই বয়সী। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে যেসব সাইবার অপরাধ ঘটে সেসবের তথ্য পাওয়া যায় না। বর্তমানে গুজবও একটা মারাত্মক বিষয়। আন্তর্জাতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকাশিত সংবাদের ৮০ শতাংশ অসত্য। এজন্য সচেতনতামূলক কাজের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকেও আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সুলতানা ইশরাত জাহান বলেন, অনেকে সাইবার অপরাধের শিকার হয়েও অভিযোগ করেন না। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনকে আইন মেনেই কাজ করতে হয়। তাই আইনি প্রতিকারের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং অপরাধের শিকার হলে দ্রুত নিকটস্থ থানায় অথবা সিআইডি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। তাহলে আইনি প্রতিকার মিলবে।
অপরাধের ধরন
জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-মোবাইলফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি। এবারের জরিপে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী কিছুটা বেড়ে ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে, যা গতবারের প্রতিবেদনে ছিল ৫০ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এবার দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং বা তথ্য চুরি। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপপ্রচার চালানো এবং অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো।
এবারের জরিপে সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। তবে চিন্তার বিষয় এই যে, গতবারের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু এবার তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা গতবারের তুলনায় ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
এছাড়াও যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও (পর্ণোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি এবং ফটোসপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যৌন হয়রানির পরিমাণ গতবার ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল, কিন্তু সেটা এবার বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা গতবারের প্রতিবেদনে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ পাওয়া গেলেও এবার তা ১ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড় গিয়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
করোনা মহামারির কারণে বিশাল সংখ্যক মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে গেছে। জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১৫ দশমিক ০৬ শতাংশ মানুষ অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক মাধ্যমে বেড়েছে অপপ্রচার ও অপরাধ প্রবণতা
বিগত চার বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার কমলেও গত বছর এই ধরনের অপরাধের প্রবণতা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ফটোশপে ছবি বিকৃতির ঘটনাও নতুন করে বাড়ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে অনলাইন কেনাকাটায়। ই-কমার্স খাতে চার বছরে ধারাবাহিক অপরাধ বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
ভুক্তভোগীদের বয়স
এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগের বয়স ১৮-৩০ বছর এবং এই হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ১৮ বছরের কম বয়সী ভুক্তভোগী এবং এই ভুক্তভোগীদের হার ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৩১-৪৫ বছর বয়সের ভুক্তভোগী যাদের হার ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ ও সর্বশেষ অবস্থান করছে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বের ভুক্তভোগী, যার হার ০ দশমিক ৫০ শতাংশ।
১৮-৩০ বছর এবং ১৮ এর চেয়ে কম বয়সের ভুক্তভোগীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি হ্যাকিং বা তথ্য চুরির মতো সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন বেশি। আরেকটি আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সী ভুক্তভোগীদের বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় ৪.৬৪ শতাংশ বেশি এসেছে এবারের জরিপে।
জেন্ডারভিত্তিক অপরাধ
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পরিলক্ষিত হয়েছে, নারী ও পুরুষের মধ্য সাইবার অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হয়েছেন। সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের জেন্ডারভিত্তিক পার্থক্য করলে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্য পুরুষের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ২২শতাংশ ও নারীদের সংখ্যা ৫৬ দশমিক ৭৮শতাংশ। এছাড়াও পুরুষের তুলনায় নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফি শিকার বেশি হয়েছেন।
অন্যদিকে, নারীদের তুলনায় পুরুষরা মোবাইল ব্যাংকিং বা এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ের শিকার বেশি হয়েছেন। আর অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভুক্তভোগীই জানেন না আইন ভুক্তভোগীদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন ৪৩ দশমিক২২ শতাংশ। বাকি ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভুক্তভোগীর দেশে বিদ্যমান আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে গত বছরের তুলনায় এ বছর ২১ দশমিক ০৭ শতাংশ কম ভুক্তভোগী তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন।