চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ১৯৪ জনই স্কুলগামী। ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি, যা মোট আত্মহত্যার ৭৮.৬ শতাংশ।
গতকাল শুক্রবার আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
‘বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার : আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া কতটা জরুরি?’ শীর্ষক এক সমীক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদনে তারা এ তথ্য প্রকাশ করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এ সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, উল্লিখিত আট মাসের প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ৩৬৪ জন আত্মহত্যাকারীর মধ্যে স্কুলগামী ৫৩.৩০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে কলেজ শিক্ষার্থীরা। তারা সংখ্যায় ৭৬ জন, যা ২০.৮৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননকারীর সংখ্যা ৫০, যা ১৩.৭৪ শতাংশ। আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদরাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীও রয়েছে। তারা ৪৪ জন, যা ১২.০৯ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় শীর্ষে ঢাকা বিভাগ। ঢাকায় গত আট মাসে ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। চট্টগ্রাম বিভাগে এই হার ১৬.৪৮ শতাংশ এবং খুলনা বিভাগে ১৪.০১ শতাংশ। রংপুর বিভাগে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী ৮.৭৮ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ৯.৬২ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭.৪২ শতাংশ এবং রাজশাহী বিভাগে ১৪.০১ শতাংশ। সিলেট বিভাগে তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যা ৪ শতাংশ।
আত্মহত্যায় নারী শিক্ষার্থী বেশি। তারা ২২১ জন বা ৬০.৭১ শতাংশ। পুরুষ শিক্ষার্থী ১৪৩ জন বা ৩৯.২৯ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ। কলেজপড়ুয়া আত্মহত্যাকারী ৭৬ জন। এর মধ্যে ৪৬.০৫ শতাংশ পুরুষ ও ৫৩.৯৫ শতাংশ নারী। স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যায় ওপরে। তারা ১৯৪ জন। এর মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ পুরুষ ও ৬৭.০১ শতাংশ নারী। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৪ জন আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ পুরুষ ও ৬০.৭১ শতাংশ নারী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি, যা ৭৮.৬ শতাংশ। ২১ থেকে ২৬ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৩.৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ১৩ বছরের নিচে যাদের বয়স, তারাও এই পথ থেকে পিছপা হয়নি। ছয় থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭.৯৭ শতাংশ, অর্থাৎ ২৯ জন আত্মহত্যা করেছে। ১৪ থেকে ১৬ বছরের কিশোর-কিশোরী সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে, যার সংখ্যা ১৬০।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছে। অভিমান করে আত্মহত্যা ২৪.৭৩ শতাংশ। পরিবারের সঙ্গে চাওয়া-পাওয়ার অমিল হওয়ায় আত্মহত্যা করেছে ৭.৪২ শতাংশ। পারিবারিক কলহ থেকে আত্মহত্যা ৬.৫৯ শতাংশ।
ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি থেকে আত্মহত্যা ৪.৬৭ শতাংশ। মানসিক সমস্যা থেকে ৬.৫৯ শতাংশ। পড়াশোনার চাপে ০.৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় ০.৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১.৯২ শতাংশ।
চুরির মিথ্যা অপবাদে ১.৬৫ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ১.৯২ শতাংশ, বন্ধুর মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা ০.৫৫ শতাংশ। বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ও স্বামী পছন্দ না হওয়ায় আত্মহত্যা ১.১০ শতাংশ। তবে ১৫.৯৩ শতাংশের আত্মহননের কারণ জানা যায়নি।
আত্মহত্যার পেছনে সাইবার অপরাধও রয়েছে। আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও মোবাইলে ধারণের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার করেছে চার শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করে আটজন। ভিডিও কলে এসে আত্মহত্যা করেছে দুজন। সেলফি ক্যামেরা নিজের দিকে তাক করে আত্মহত্যা ০.২৭ শতাংশ প্রেমিক যুগলের। চিরকুট বা সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেছে আটজন।
ভার্চুয়াল সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ। শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছে।
তিনি বলেন, সাত বছরের একশিশুও আত্মহত্যা করেছে। যার আত্মহত্যা বোঝার বয়স হয়নি। তার আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোও বিশ্লেষণ করে শিশু অবস্থা থেকেই শিক্ষার্থীদের মনোবল শক্ত করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, উদ্বেগজনক হারে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা রোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আঁচল ফাউন্ডেশনের ১০টি প্রস্তাব
আত্মহত্যা মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন, পাঠ্যপুস্তকে মানসিক শিক্ষাকে এবং মনের যত্নের কৌশলগুলোকে বাস্তবায়ন করা, অভিভাবক সমাবেশের আলোচিত সূচিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা সম্পর্কিত এজেন্ডা রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা, প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও বাস্তবায়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইন পরিচালনা, অনলাইনে হতাশা-আপত্তিকর ছবি-আত্মহত্যার লাইভ স্ট্রিমিং, জীবননাশের পোস্ট চিহ্নিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ টুলস ব্যবহার করা, পরিবার ও পরিচিতজনদের দায় অনুসন্ধানে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে এককভাবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে।
যেকোনো একটিতে গুরুত্ব দিলে হবে না। পরিবারের পরিবেশ ভালো রাখা হলো, কিন্তু দেখা গেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বুলিং হচ্ছে। তা যেন না হয়। পাশাপাশি শুধু শিশুর শারীরিক বিকাশ নয়, তার মানসিক বিকাশেও যত্নশীল হতে হবে।