সাংবাদিক আমির মেহমুদ (ছদ্মনাম) যখন কাজের জন্য বের হচ্ছিলেন তখন হঠাৎ তার হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ টোনটি বেজে উঠল। পাকিস্তানের একটি লাহোরভিত্তিক বেসরকারি নিউজ চ্যানেলের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করায় প্রতিদিনই তার কাছে অসংখ্য মেসেজ আসতেই থাকে। তবে মঙ্গলবার সকালের মেসেজটি একটু ভিন্নরকমই ছিল। কারণ মেসেজটি পাঠিয়েছেন দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তা। সেটি দেখার পর সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটি খুলে দেখতে পান, তাতে পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মেহমুদ বলেন, ‘মূলত, তিনি আমাদের চ্যানেলে নির্বাচন বিষয়ে প্রচারিত কিছু অনুষ্ঠানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমরা যেন আগামীতে পিটিআইর পতাকা না দেখাই বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র নিয়ে কিছু উল্লেখ না করি। তিনি নির্দেশ দেন, এ ধরনের প্রার্থীদের পিটিআই সমর্থিত না বলে ‘স্বতন্ত্র’ বলতে হবে এবং তারা কোন দলের সমর্থন পাচ্ছেন, তা উল্লেখ করা যাবে না।’
কেবল মেহমুদ নয়। মেহমুদের মতো একইরকম বার্তা পেয়েছেন পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকরা। খবর আল-জাজিরার
তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই দলটি গঠন করেন পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী সাবেক তারকা ক্রিকেটার ও অধিনায়ক ইমরান খান। বিশ্লেষকদের মতে, পিটিআই পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। তবে আগস্ট ২০২৩ থেকে কারাগারে বন্দি আছেন ইমরান। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। যদিও ইমরান খান সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
২০২২ এর এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন ইমরান। এরপর থেকে ইমরানের দলের বিরুদ্ধে চলছে দমন-পীড়ন। পিটিআইর হাজারো সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কয়েক শ নেতা দল ছাড়তে বাধ্য হন। অভিযোগ আছে, সামরিক বাহিনীর চাপে অনেকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
এদিকে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ইমরান খান ও তার দলের বেশ কয়েকজন নেতার মনোনয়নপত্র নাকচ করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন এমন কী পিটিআইর নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট বাতিল করে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করা হলেও আদালত নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছেন।
ইমরান খান নিজেও অভিযোগ করেছেন, গণমাধ্যমেও সেন্সরশিপ বসানো হচ্ছে। তিনি বলেন, আগে তাকে বিরোধীরা বাছাইকৃত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তকমা দিত। কিন্তু এবারের নির্বাচনে যে বাছাই হতে চলেছে, তা সব বাছাইয়ের মা।
পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো ইতোমধ্যে ইমরান খানকে নিয়ে প্রতিবেদন করা থেকে বিরত রয়েছে। কিন্তু এখন পিটিআইয়ের কভারেজের ওপর বিধিনিষেধও বিস্তৃত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
‘নো ফ্ল্যাগ, নো রেফারেন্স’
মেহমুদ হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তার বসের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপরই চ্যানেলটি সিদ্ধান্ত নেয়, সব ধরনের ভিজুয়াল, গ্রাফিক্স, আলোচনা-সূচি থেকে পিটিআইর নাম বাদ দেওয়া হবে এবং পিটিআই প্রার্থীদের শুধু স্বতন্ত্র বলে অভিহিত করা হবে। এবং পিটিআইয়ের সব রেফারেন্স মুছে ফেলা হবে। কোন প্রার্থী দলটির প্রতিনিধিত্ব করছে এর কোন নিশানা থাকবে না।
আল-জাজিরা যে সাতজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছে তারা নিজেদের রক্ষার্থে একজন ছাড়া বাকি সবাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেন। মেহমুদসহ তিনজন নিশ্চিত করেন, তাদেরকে পিটিআই’র পতাকা বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে দলটির যোগসূত্র নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
তারা বলেন, আমাদের বলা হয়েছে- পিটিআইয়ের দলীয় পতাকা এবং তাদের নাম প্রদর্শন করা যাবে না এমনকি দলের নামও উচ্চারণ করা যাবে না।
তবে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথ্যমন্ত্রী মুরতাজা সোলাঙ্গি এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি আল-জাজিরাকে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় জানান, ‘আমরা এ ধরনের কোনো নির্দেশ দেইনি’।
অকাট্য হুমকি
কেবল সাংবাদিকরাই নয়, সেন্সরশিপের অভিযোগ করেন মানবাধিকারকর্মীরাও। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, পাকিস্তান সরকার গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে।
এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, নির্বাচনে কারচুপি এবং ভিন্নমত দমন করতেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মেহমুদ বলেন, সামরিক প্রতিষ্ঠান থেকে আসা এই নির্দেশনার মডেল দীর্ঘদিনের। এর আগে অন্য দলগুলো ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। এবার পিটিআইয়ের পালা।
তিনি আরও বলেন, এমনকি ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং পিটিআই ক্ষমতায় ছিলো তখনো রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মতো আন্তর্জাতিক মিডিয়া ওয়াচডগ সাংবাদিকদের হয়রানি, ভয় ও হুমকি দেখানোর নিন্দা জানিয়ে প্রতিবেদন করেছিল।
এখন ইমরান খান এবং তার দলের পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মেহমুদ। তিনি বলেন, অনেক সাংবাদিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোন কারণ ছাড়াই তাদেরকে মাসের পর মাস বন্দি করে রাখা হয়েছে। অনেককে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
কৌশলের পরিবর্তন
পাকিস্তানের বৃহত্তম মিডিয়া জিও-তে কাজ করা একজন প্রবীণ সাংবাদিক আজাজ সৈয়দ বলেন, গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ করা এবং সেন্সরশিপ জারি করার বিষয়টি কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। পাকিস্তানি সাংবাদিকতার বাস্তবতা এবং কৌশলগুলি এখন পরিবর্তিত হচ্ছে।
অতীতের বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে সৈয়দ বলেন, গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করা হচ্ছে এখন। তাদেরকে ইমরান রিয়াজ খানের মতো টার্গেট করা হচ্ছে। তাদের ওপর মিডিয়া মালিকদের এবং প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের কর্মকর্তা দিয়ে ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত ইমরান রিয়াজ খান একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক। গত মে মাসে ওমান যাওয়ার পথে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং চার মাস পর তিনি মুক্তি পান।
ইসলামাবাদভিত্তিক একজন টিভি সাংবাদিক বলেন, তিনি এর আগে দেশটির সেনাবাহিনীর মিডিয়া শাখা থেকে সরাসরি ফোন পেতেন সংবাদ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। এখন সেই টেলিভিশিন চ্যানেলটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা হচ্ছে
মূলধারার গণমাধ্যমগুলো যখন কী সম্প্রচার করা হবে এবং কী করা হবে না এসব বিষয়ে বাধার মুখোমুখি হচ্ছে তখন বিষয়গুলো সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে করে গুজব ছড়ানোর পাশাপাশি মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।
পিটিআইয়ের মতো গত এক বছরে ছয়টির বেশি অনুষ্ঠান বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশেও বিধিনিষেধ জারি করা হয়। যার তিনটি অনুষ্ঠানই ছিল পিটিআইয়ের ইভেন্ট।
এমনকি গত ২২ জানুয়ারি সরকারি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের দিনে যে কোন মুহুর্তে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।
পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথ্যমন্ত্রী মুরতাজা সোলাঙ্গি বলেছেন, ইন্টারেনট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণটি মূলত প্রযুক্তিগত। এছাড়াও ভবিষ্যতে যে এমনটি আর হবে না, এর কোন নিশ্চয়তা নেই।