স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে পাকিস্তান। পানির নিচে তলিয়ে গেছে দেশটির এক–তৃতীয়াংশ এলাকা। মৃতের সংখ্যা এরইমধ্যে ১৩শ’ ছাড়িয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। কোলের শিশু নিয়ে প্রলয়ঙ্করী বন্যার ছোবল থেকে পালিয়ে বাঁচার মতো ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে অনেকে।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ সিন্ধু প্রদেশ। তবে সেখানে এখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দাদু জেলার উপকূলীয় এলাকায় এখনও পানির স্তর বাড়ছে। সিন্ধু নদীতে পাহাড়ি ঢল উপচে পড়ায় বিপাকে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ।
কোথাও কোথাও আট ফুট পানির নিচে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা। আরও বাড়ছে পানি। বন্যায় বহু ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। মাইলের পর মাইলজুড়ে শুধু পানি আর পানি।
সন্তানের দিকে তাকালে মায়ের চেহারা যেন কোমল হয়ে যায়। বাদল শান্তিতে ঘুমায় ঠিকই, কিন্তু উদ্বেগ উৎকণ্ঠা পিছু ছাড়ছে না তার মায়ের। কারণ এই বন্যা তাদের এমন জায়গায় ঠেলে দিয়েছে যেটি আসলে কোনও শিশুর বসবাসের জায়গা হতে পারে না। নাজিমা আব্বাসের ভাষায়, ‘শুধু এই গাছ ছাড়া আমাদের একটা তাঁবুও নেই।’
বন্যায় গৃহহীন মানুষে পরিণত হওয়া ভাগ্যবিড়ম্বিত এই নারী বলেন, ‘আমরা সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে কাটিয়েছি। বন্যা থেকে পালিয়ে নিরাপদে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এখানে পৌঁছে একমাত্র এই জায়গাটিই খুঁজে পাই। বাচ্চাটা কাঁদতে শুরু করে, সে থামে না। এটা একটা কঠিন পরিস্থিতি।’
কাছাকাছি একটি হাসপাতালে জন্ম নিয়েছিল বাদল। কিন্তু একদিনের মধ্যেই নাজিমাকে তাদের নদী তীরের বাড়িতে ফিরতে হয়। কেননা এই প্রলয়ঙ্করী বন্যার মধ্যেই স্বামী এবং পাঁচ সন্তানকে রেখে যেতে হয়েছিল তাকে। পরে পানি বাড়তে থাকায় সেখান থেকে সবাইকে নিয়ে অন্যত্র গাছতলায় গিয়ে আশ্রয় নেন।
বিবিসির সাংবাদিক পুমজা ফিহলানির প্রশ্ন ছিল, বন্যার কবল থেকে পালিয়ে আসার সময় কী নিয়ে আসতে পেরেছিলেন? উত্তরে নাজিমা আব্বাস বলেন, ‘এই দুইটি খাট আর দুইটি মুরগি। আর কিছু না।’
দুই সপ্তাহ আগে কালী মরি গ্রামে আশ্রয় নিলেও এখনও সেখানে কোনও সাহায্য পৌঁছায়নি বলে জানান এই নারী। তীব্র ক্ষুধা নিয়েও তার উদ্বেগ পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে এই গ্রামটিও প্লাবিত হয়ে গেলে কোথায় ঠাঁই মিলবে তাদের?
তার ভাষায়, ‘আমরা এখানে শুধু এই আশা নিয়ে বসে আছি যে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করবেন। সরকার কোনও রেশন দিচ্ছে না বা সাহায্য করার জন্য কিছু করছে না। আমি জানি না আমাদের কী হবে। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’
কালী মরি গ্রামের আরেকটি অংশে মরিয়ম আব্বাস নামের একজন সন্তানসম্ভবা নারীর সঙ্গে কথা হয় বিবিসির। যে কোনও দিন তার সন্তান প্রসব হতে পারে। মরিয়ম আব্বাসের ভাষায়, ‘আমার ইতোমধ্যেই আটটি সন্তান আছে, দেখুন আমরা কোথায় থাকি। ঠিকমতো সন্তাদের দেখভালটুকুও করতে পারছি না।’
এই নারী জানালেন, কখনও কখনও তাদের কয়েক দিন পর্যন্তও না খেয়ে থাকতে হয়। এমন বাস্তবতায় নিজের স্বাস্থ্য ও অনাগত সন্তানকে নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। তার ভাষায়, ‘আমার কাছে হাসপাতালে যাওয়ার মতো টাকাও নেই। এখানে অসুস্থ হলে কি করবো বুঝতে পারছি না।’
এবারের বন্যায় বেলুচিস্তান, সিন্ধু প্রদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। খাইবার পাখতুনখোয়া এবং পাঞ্জাবের কিছু কিছু অংশ তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলও। টানা বর্ষণে আকস্মিক বন্যায় বহু-ঘর বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎসংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত। প্লাবিত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছে দিতে বেশ ভুগতে হচ্ছে জরুরি বিভাগের সদস্যদের। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই কাজে অংশ নিয়েছে। সেনা, নৌবাহিনী এবং বিভিন্ন এনজিওর স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় কয়েক লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান ইকবাল বলেছেন, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ব্যাপক। ক্ষতিগ্রস্ত তিন কোটি ৩০ লাখ মানুষের জন্য ব্যাপক পরিসরে মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। পাকিস্তানি প্রবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহায়তার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের এমন ভয়ঙ্কর সংকট প্রত্যক্ষ করার পরও চোখ বন্ধ করে রাখা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস।
বন্যাদুর্গতদের জন্য তিন কোটি ডলারের মানবিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও সহায়তা বিষয়ক সংস্থা ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)-এর এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে মানবিক সহায়তা হিসেবে তিন কোটি ডলারের তহবিল দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ইউএসএআইডি-এর মাধ্যমে দেশটিকে এই সহায়তা দেওয়া হবে। এর আগে ইসলামাবাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত ২৮ আগস্ট বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠায় তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ভারী বর্ষণজনিত এই বন্যায় গত জুন থেকেই প্লাবিত হয়ে আছে পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ভূমিধস ঘটছে। নদীর তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে বহু ঘরবাড়ি ও সেতু। পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শেরি রেহমান উদ্ভূত বাস্তবতাকে একটি ‘দানবীয় বর্ষা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিকে ২০১০ সালের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। সে বছর বন্যায় দুই হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। পানির নিচে ডুবে যায় দেশের এক পঞ্চমাংশ এলাকা। সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা।