অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার মাঝ বরাবর নতুন একটি রাস্তা তৈরি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। রাস্তাটি গাজার পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে গেছে। স্যাটেলাইটের ছবিতে ধরা পড়েছে বিষয়টি।
ইসরায়েলের দাবি, পণ্য ও ত্রাণ সরবরাহের উদ্দেশ্যে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এটি হয়তো স্থায়ী অবকাঠামো হতে পারে।
তাদের আশঙ্কা, রাস্তাটিকে হয়তো একটি প্রাচীর হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে, যেন ফিলিস্তিনিরা গাজার উত্তরাঞ্চলে নিজেদের বাসস্থানে ফিরে যেতে না পারেন। এটি চলমান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও গাজার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ব্যাপারে ইসরায়েলি পরিকল্পনার অংশ হতে পারে।
নতুন রাস্তাটি নাহাল অজ কিবুৎজের কাছে ইসরায়েল-গাজার সীমান্ত প্রাচীর থেকে শুরু হয়েছে। এটি গাজার ওপর দিয়ে গিয়ে পশ্চিমে উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
যদিও ছোট আরও অনেক রাস্তা রয়েছে যেগুলো গাজার পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলকে যুক্ত করেছে, তবে ইসরায়েলের তৈরি করা নতুন রাস্তাটি একেবারে সোজাসুজি গিয়ে ফিলিস্তিনি এলাকাটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে।
রাস্তাটির সঙ্গে সালাহ আল-দীন এবং আল-রশীদ সড়কেরও সংযোগ রয়েছে। এ দুটি রাস্তা গাজার সড়ক নেটওয়ার্কের মূল ধমনীর মতো কাজ করে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধপরবর্তী গাজার বিষয়ে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন, যেখানে ইসরায়েল অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করবে।
নবনির্মিত রাস্তাটি গাজা নিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধ পরবর্তী কৌশল নিয়ে বিতর্ক আবারও উসবে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাস্তা সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
বিবিসির বিশ্লেষণ করা স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, এর আগে থাকা সংযোগহীন সড়কগুলো সংযুক্ত করতে ইসরায়েলি বাহিনী পাঁচ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা নতুন করে তৈরি করেছে।
ইসরায়েলি সীমান্তের কাছে গাজার পূর্বাঞ্চলে এই রাস্তাটির প্রথম অংশ নির্মাণ শুরু হয় গত অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের শুরুর মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু রাস্তাটির বেশিরভাগ অংশই তৈরি করা হয়েছে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের প্রথম দিকে। শুধু সালাহ আল-দীন সড়ক ছাড়া গাজার বাকি সব রাস্তার তুলনায় নতুন রাস্তাটি বেশ চওড়া।
ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাস্তাটির পাশে যেসব ভবন ছিল, সেগুলো গত ডিসেম্বর মাসের শেষ থেকে শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি বহুতল ভবনও রয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এই রাস্তা সম্পর্কে খবর প্রচারিত হয়, যেখানে এটিকে ‘হাইওয়ে ৭৪৯’ নামে উল্লেখ করা হয়।
কী কাজে ব্যবহার হবে?
জেনস নামে একটি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কোম্পানির বিশ্লেষকরা বলেন, চ্যানেল ফোরটিনের ভিডিওতে যে কাঁচা রাস্তা দেখা গেছে, সেটি সাঁজোয়া যান চলাচলের জন্য উপযুক্ত।
ইসরায়েলি বাহিনী যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। তারা বলেছে, স্থল অভিযানের অংশ হিসেবে যাতায়াতের জন্য নতুন একটি রাস্তা ব্যবহার করছে আইডিএফ।
ইসরায়েলের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক প্রধান জেনারেল জ্যাকব নেগেল রাস্তাটির নিরাপত্তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ইসরায়েলের জন্য গাজার ভেতরে প্রবেশ ও বের হতে সুবিধা হবে… কারণ গাজার পূর্ণ প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা এবং সব ধরনের দায়িত্ব থাকবে ইসরায়েলের হাতে।
তিনি এটিকে ‘গাজার উত্তরাঞ্চলকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্নকারী রাস্তা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সাবেক ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা জাস্টিন ক্রাম্প বলেছেন, দেখে মনে হচ্ছে, গাজা উপত্যকায় নিরাপত্তা হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি কোনো কৌশলের অংশ।
তিনি বলেন, এই এলাকা গাজা শহরটিকে উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে পৃথক করে ফেলছে, যা একে একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করছে। এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে, গুলি ছোড়ার জন্য তুলনামূলক খোলা এলাকাও তৈরি করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো খালিদ এলগিন্ডিও মনে করেন এই রাস্তাটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ। তার কথায়, মনে হচ্ছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অনির্দিষ্ট সময় ধরে গাজায় অবস্থান করবে।
এ বিশ্লেষক বলেন, গাজাকে অর্ধেকে ভাগ করার মানে হচ্ছে, ইসরায়েল শুধু গাজায় প্রবেশ ও বের হওয়ার ওপরই নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছে না, বরং গাজার অভ্যন্তরীণ চলাচলের ওপরও তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এর অর্থ হতে পারে, গাজার দক্ষিণে আশ্রয় নেওয়া ১৫ লাখ ফিলিস্তিনিকে উত্তরাঞ্চলে তাদের বাড়িঘরে ফিরতে না দেওয়া।