বছর পাঁচেক আগেও জার্মানির চিত্র এমন ছিল না। কর্মক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর তেমন অভাব ছিল না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত কাজের লোক ছিল। শুধু জার্মানরা নন, ভিনদেশ থেকেও চাকরি করতে জার্মানিতে পাড়ি দিতেন বহু মানুষ। কিন্তু ২০২০ সালের পরে সে ছবি আচমকা পাল্টে যেতে থাকে। হঠাৎ করেই জার্মানি ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়।
আবার এই মুহূর্তে জার্মানির আর্থিক অবস্থাও ভালো না। দক্ষ শ্রমিকের অভাবে থমকে গেছে দেশটির শিল্পোৎপাদন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ সংকট কাটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দেশটি। নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও অনেক বদল আনা হয়েছে। দক্ষ বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা বাড়াতে উদ্যোগী হচ্ছে জার্মান সরকার।
জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টেইনমায়ার ও শ্রমমন্ত্রী হুবার্টাস হেইল বর্তমানে ভিয়েতনাম সফরে রয়েছেন। সে দেশের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন তারা। কিছু চুক্তিও সই করেছেন। উদ্দেশ্য একটাই, জার্মানিতে কাজ করতে যাওয়ার জন্য সে দেশের তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করা।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচেভেলের (ডিডব্লিউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভিয়েতনামি-জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় সেখানকার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার। অনেকেই নাকি জার্মান সংস্থায় কাজ করার জন্য উৎসাহ দেখিয়েছেন। তাছাড়া ভিয়েতনামে প্রতি বছর বহু তরুণ-তরুণী জার্মান ভাষা শিখছেন বলেও জানিয়েছেন ওয়াল্টার।
২০২৩ সালের শেষদিকে জার্মান সরকার নতুন অভিবাসন আইন প্রণয়ন করেছে। যার ফলে সহজেই জার্মানির নাগরিকত্ব পাবেন অভিবাসীরা। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষ বিদেশি কর্মীর অভাব মেটাতেই অভিবাসন আইনে পরিবর্তন এনেছে দেশটি।
নতুন অভিবাসন আইনের অধীনে জার্মানিতে পাঁচ বছর বসবাস করলেই জার্মান পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবেন বিদেশিরা। এমনকি, ইন্টিগ্রেশন বা জার্মান সমাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ‘অসাধারণ যোগ্যতা’ অর্জন করলে তিন বছরের মধ্যেই নাগরিকত্ব অর্জনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
শুধু ভিয়েতনাম নয়, মরক্কো, ফিলিপিন্স, ভারতের মতো দেশগুলোতেও সফরে যাচ্ছেন জার্মানের বিভিন্ন মন্ত্রী, আমলারা। জার্মানির ফেডারেল এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির তথ্যানুসারে, সে দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিতে ১৭ লাখেরও বেশি শূন্যপদ রয়েছে।
সমীক্ষা বলছে, এখন যে পরিস্থিতি তাতে, জার্মানিতে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ কর্মীর প্রয়োজন। সম্প্রতি দেশটির শ্রমমন্ত্রী হুবার্টাস হেইল জার্মানিকে কাজের উপযুক্ত গন্তব্য হিসেবে প্রচার করতে ভারত, ব্রাজিল, কেনিয়া সফর করেছেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শ্রম বাজারের চাহিদা মেটাতে জার্মান সরকারের কাছে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ একই সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন কমাতে কড়া পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা করছে জার্মান সরকার ও দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নির্মাণশিল্প, কৃষি ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে জার্মান সরকার। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, জার্মানি যে ব্যবস্থাই নিক না কেন, তাদের এই সমস্যা আরও কয়েকবছর থাকবে। কর্মীসংকট মেটাতে সরকারকে একই সঙ্গে উদার ও কঠোর নীতি অবলম্বন করতে হবে বলেও মনে করছে একাংশ।
প্রশ্ন উঠছে, কেন জার্মানি ছাড়তে শুরু করেছিলেন বিদেশিরা? এর অন্যতম কারণ হলো- সেদেশে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে জার্মান ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। একটা সময় ছিল যখন জার্মান রাজনীতিবিদেরা ইংরেজি বলতেই চাইতেন না।
তাছাড়া দেশটির বড় একটি সমস্যা ছিল বর্ণবিদ্বেষ। বাইরে থেকে যাওয়া লোকজনদের সহজে নিজেদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইতেন না অধিকাংশ জার্মান নাগরিক। এসব সমস্যার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত কয়েক বছরে অনেকেই জার্মানি ছেড়ে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে চলে গেছেন।
জার্মানির অর্থনীতি মূলত রপ্তানি-নির্ভর। তাছাড়া দেশটিতে বিশ্বের বড় বড় অনেক সংস্থার কার্যালয়ও রয়েছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য বিদেশি কর্মী হারিয়ে শিল্পোৎপাদন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে দেশটির সরকার।
কর্মীসংকট কাটিয়ে উঠতে প্রথমেই যে সিদ্ধান্ত নেয় জার্মান সরকার, সেটি হলো- কর্মক্ষেত্রে ভাষা যাতে বাধা না হতে পারে, তাই ইংরেজির ওপর জোর দেওয়া। এতে কিছুটা উন্নতি হলেও বর্ণবিদ্বেষের বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগের হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও দেশটির শ্রমমন্ত্রী হেইল সংবাদমাধ্যম ডিডব্লিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, কেউ তার সঙ্গে সরাসরি এ সমস্যা নিয়ে কথা বলেননি।
আবার জার্মানিতে অনেক ভুয়া সংস্থা রয়েছে, যারা মোটা বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে অদক্ষ বিদেশিদের সে দেশে নিয়ে যায়। মানব পাচারের সমস্যাটিও জার্মান সরকারের অন্যতম মাথাব্যথার কারণ।
পাচারকারীদের মূল টার্গেট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নারীরা। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের জার্মানিতে পাচার করা হয় ও সেখানে পৌঁছানোর পর এই নারীরা বুঝতে পারেন যে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ কারণেও অনেকে জার্মানি এড়িয়ে চলেন। তবে এবার ভুঁইফোড় এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে চলেছে জার্মান সরকার।