গত ২৩ মে অল্প সময়ের জন্য মনে হয়েছিল যেন, তাইওয়ানের প্রতি মার্কিন নীতিতে হঠাৎ করেই নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। তাইওয়ানে চীনের সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে কি না তা জানতে চাইলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো তিনি একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাইওয়ানের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে ‘জাদুর পাহাড়’ হিসেবে পরিচিত দেশটির হুগুও শেনশান যা জাতিকে রক্ষায় ভূমিকা পালন করছে। এই পর্বতটি অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষামূলক দুর্গ নয় বা বড় কোনো শক্তির সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো চুক্তিও হয়নি।
তাইওয়ানে ১৪৭ বিলিয়ন সেমিকন্ডাক্টর শিল্প তাদের জিডিপির ১৫ শতাংশের সমান। রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশই এই খাত থেকে আসে এবং এটি তাইওয়ানের অর্থনীতির একটি স্তম্ভ। এটি দেশটির নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ তৈরি করে থাকে। এর ফলে ভোক্তা প্রযুক্তি, গাড়ি এবং বিমান চলাচলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে এই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। মার্কিন সংস্থাগুলো (তাদের সশস্ত্র বাহিনী) তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টরের উপর নির্ভর করে।
হুগুও শেনশান পর্বতের জাদু ধরে রাখার জন্য, এই শিল্পকে অবশ্যই তার প্রযুক্তি ধরে রাখতে হবে। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) বিশ্বের বৃহত্তম চুক্তিভিত্তিক চিপ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে উন্নত ধরণের চিপের বাজারের ৯০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে তারা।
দশ ন্যানোমিটারের চেয়ে ছোট বা কাগজের শীটের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার গুণ পাতলা চিপগুলো আইফোন থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটিং ডিভাইসগুলোর কেন্দ্রে বসানো হয়। টিএসএমসি ছাড়া কেবলমাত্র দুটি কোম্পানি ইন্টেল এবং স্যামসাং সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করতে পারে। কিন্তু তাদের প্রযুক্তি টিএসএমসি-এর মতো এত উন্নত নয় এবং তারা দ্রুতগতিতে তা উদ্ভাবনও করতে পারছে না।
চিপ ডিজাইন করার পরিবর্তে এগুলো তৈরির ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়েই আধিপত্য অর্জন করেছে টিএসএমসি। অতিবেগুনী এচিং লাইটের একটি অতি-নির্ভুল রূপ তৈরি করতে সাবঅ্যাটমিক কণাগুলোকে এদিক-সেদিক করার জটিল প্রক্রিয়াগুলোর কারণেই তারা বিশ্বে সেরা। এই প্রক্রিয়া কিভাবে কাজ করে তা সরাসরি জানানো সম্ভব নয়। কারণ এক্ষেত্রে অনেক স্তরের বাণিজ্য গোপনীয়তা জড়িত। আর টিএসএমসি চায় না যে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলো এই সক্ষমতা অর্জন করুক। যদিও তারা তা জানার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। সিনচু সায়েন্স পার্কেই তাইওয়ানের বেশিরভাগ চিপ কোম্পানি অবস্থিত।
সেমিকন্ডাক্টর চীনের জন্য একটি বড় এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে নিজস্ব চিপের ৭০ শতাংশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তারা ২০১৪ সালে ১৩৯ বিলিয়ন ইউয়ানের একটি জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর ফান্ড গঠন করেছে। ২০১৯ সালে এই ফান্ডে আরও ৩০ বিলিয়ন ডলার যোগ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার তাদের নিজস্ব তহবিলে আরও ২৫ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করেছে। ২০২০ সালে চীন যখন তাদের ব্যবহৃত চিপগুলোর ১৬ শতাংশ উত্পাদন করেছে তখন এটি সবচেয়ে উন্নত চিপ নির্মাতাদের জন্য দশ বছরের কর্পোরেট-ট্যাক্স ছাড়ের ঘোষণা করেছিল। সে বছর চীনের শীর্ষস্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারকের কাছে চিপ তৈরির সরঞ্জাম রপ্তানি সীমাবদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র।
বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা চীনে চিপ শিল্পের সম্প্রসারণে বড় ভূমিকা রেখেছে এবং তাইওয়ানের অনেক প্রকৌশলী ও নির্বাহীকে আকৃষ্ট করেছে। তাইওয়ান সরকারের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তিন হাজারের বেশি সেমিকন্ডাক্টর কর্মী অর্থাৎ ৭ শতাংশ কর্মী চীনে পাড়ি জমিয়েছে।
এই ঘটনায় তাইওয়ানের কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। ২০ মে জাতীয়-নিরাপত্তা আইন এবং যেগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পরিচালনা করে তা সংশোধনে আইন পাস করা হয়। চিপ-শিল্পের ধরনগুলো সব সময় নিয়ম মেনে চলে না।
তাইওয়ান যদি নিজেদের সফলতা ধরে রাখতে চায় তবে সরকারের অস্পষ্ট আইনের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। অন্যান্য সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলোকে তাদের নিজস্ব নীতিতে বাণিজ্য গোপনীয়তা রক্ষা করতে সাহায্য করবে, যা বাস্তবায়ন করা ব্যয়বহুল হতে পারে।