ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার সুরগানা তালুকের ছোট গ্রাম দাণ্ডিচি বারি। সারা গ্রামে সব মিলিয়ে ৩০০ জনের বসবাস। কিন্তু ওই গ্রামে কোনো পুরুষের বিয়ে হলে আনন্দ করার বদলে আতঙ্কে কাটে সেই পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে গ্রামের বাকিদের।
বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও সুখী সাংসারিক জীবন কেমন হয় তা ওই গ্রামের অনেক পুরুষই জানে না।কারণ গ্রামটিতে বেশির ভাগ নারী বিয়ের পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।
কিন্তু এমনি এমনি এমনটি করে না। বিশেষ এক কারণে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি ছাড়ে ওই গ্রামের নববধূরা। দাণ্ডিচি বারি গ্রামের বাসিন্দারা সারা বছরই খাবার পানির সমস্যায় ভুগতে থাকে। তীব্র পানিকষ্টের মধ্যে থাকলেও যারা ওই গ্রামে বড় হয়েছে, তারা এই জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত।
কিন্তু সমস্যায় পড়ে তারা, যারা বাইরে থেকে এই গ্রামে আসে। আর তাদের মধ্যে অধিকাংশই নববিবাহিতা।
শ্বশুরবাড়িতে কিছুদিন কাটানোর পর তারা সুপেয় পানির সংকট নিয়ে এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে ওই গ্রামে থাকতে চায় না। বিয়ে-স্বামী-শ্বশুরবাড়ি সব ফেলে ফিরে যেতে চায় বাপের বাড়ি।
গ্রামটির বাসিন্দা গোবিন্দ ওয়াঘমারে এ রকমই একটি বিয়ের কথা শুনিয়েছেন, যা মাত্র দুই দিন টিকেছিল। গোবিন্দ বলেছেন, ২০১৪ সালে গ্রামের একজনের বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়ে মাত্র দুই দিনের জন্য স্থায়ী হয়েছিল। বিয়ের দুই দিনের মাথায় স্বামীর ঘর ছাড়ে ওই বধূ। এ ঘটনা লোকমুখে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
গোবিন্দ আরো জানান, পানি নিয়ে আসার জন্য ওই নববধূ গ্রামের বাকি গৃহবধূদের সঙ্গে পাহাড়ের নিচে গিয়েছিল। এক দিন পানি আনতে গিয়েই বুঝে গিয়েছিল যে এই গ্রামে বসবাস করা কতটা কঠিন।
অনেকটা পথ পেরিয়ে পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত গিয়ে সুপেয় পানি আনতে হয় গ্রামের নারীদের। ওই নববধূ বুঝে গিয়েছিল, ওই গ্রামে থাকলে তার জীবন কঠিন হয়ে যাবে। পালানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। তাই পানি আনতে গিয়ে সেখানেই কলসি রেখে ওই বধূ বাপের বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিল।
গোবিন্দ আরো জানিয়েছেন, এই গ্রামের নারীদের প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ মার্চ থেকে জুন মাস, দেড় কিলোমিটার হেঁটে পাহাড়ের নিচে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া একটি নদী থেকে পানি আনতে হয়।
শুকনো নদীর সামনে থাকা পাথরের ফাটল থেকে গ্রামের গৃহবধূদের পানি ভরতে হয়। নদীর ধারে থাকা পাথরের ফাটলে হাত ঢুকিয়ে একটি বাটি দিয়ে সেই পানি তুলে পাত্রে ভরতে হয় তাদের।
ফাটলের ভেতরের পানি ফুরিয়ে গেলে সেই পানি আবার ভর্তি হওয়ার জন্য নারীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এরপর দুটি করে পাত্র মাথায় চাপিয়ে তাদের আবার পাহাড় ডিঙিয়ে গ্রামে ফিরতে হয়।
গ্রামের নারীরা দিনে দুইবার পাহাড়ের নিচে পানি আনতে যান। ভোর ৪টা থেকে পানি নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু হয়। একবার পানি আনার পরের বেলায় আবার পানি আনতে যেতে হয়। গ্রীষ্মকালে বেশির ভাগ দিনই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে। সেই গরমেই পাথুরে রাস্তা হেঁটে পার হতে হয় গ্রামের নারীদের।
গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মীবাই ওয়াসলে বলেন, একটি কলসি পূর্ণ হতে তিন ঘণ্টাও লাগতে পারে। পানি ভরে ফিরতে অনেক সময়ই রাত হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে বন্য প্রাণীদের হামলার ভয়ও থাকে। আর সেই কারণে রাতে ফেরার সময় মশাল জ্বালিয়ে বাড়ি ফেরেন তারা। সঙ্গে থাকে টর্চও।
খাড়া রাস্তা ধরে মাথায় দুটি কলসি এবং হাতে টর্চ জ্বেলে বাড়ি ফেরে গ্রামের নারীরা। শুধু পানি ভরতে যাওয়া নয়, বাড়ির অন্যান্য কাজও করতে হয় নারীদেরই।
এই কষ্টকর জীবন কাটাতে রাজি থাকে না অনেক নারী। আর এ কারণে বিয়ে করে আসার পর অনেক নববধূ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
দাণ্ডিচিবারি গ্রামের প্রধান জয়রাম ওয়াঘমারে জানিয়েছেন, তিনি অনেক দিন ধরেই গ্রামের মানুষদের জন্য জলের ট্যাংক বসানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, অনেকে এসে আমাদের কষ্টের ছবি তোলেন। কিন্তু কেউ সাহায্য করেন না। আমাদের গ্রাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে খরায় ভুগছে।
জয়রাম স্বীকার করেছেন যে বিয়ে না টেকার ব্যাপারে এই গ্রামের বদনাম রয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে তিনজন বিবাহিত নারী পানির অভাবে বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রাম ছেড়েছিল।
এখন অনেকেই তাদের মেয়েদের এই গ্রামের পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয় না। জয়রাম বলেন, একবার যখন কেউ জানতে পারে যে বরের বাড়ি দাণ্ডিচি বারিতে, তখনই তারা বিয়ের আলোচনা বন্ধ করে দেয়।