ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে নজিরবিহীন যুদ্ধ চলছে। গত শনিবার ভোরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে অভিযান শুরু করে গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের যোদ্ধারা। এতদিন ইসরায়েলের বিপক্ষে শুধুমাত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছে ফিলিস্তিন। শনিবারই প্রথমবারের মতো আগে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের জুন মাসের যুদ্ধবিরতির পর প্রায় ২ বছর ধরে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা শেষে এই হামলা চালায় হামাস।
ইসরায়েলে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এই হামলার সিদ্ধান্ত ও হামলা পরিচালনাসহ প্রায় সবকিছুর মূলে রয়েছেন হামাসের কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ। তাকে এই দুর্ধর্ষ অভিযানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
শনিবার মোহাম্মদ দেইফ এক অডিও বার্তায় ইসরায়েলে অভিযানের বিষয়টি ঘোষণা দেন। এই এটিকে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’নামে আখ্যা দেন। ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা দেইফের এ ঘোষণার পরপর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে পাঁচ হাজার রকেট ছোড়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর গাজার সীমান্ত প্রাচীর ভেঙে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েন হামাসের এক হাজার যোদ্ধা।
গাজায় হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে ২০২১ সালে মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক হামলার পর ইসরায়েলে শক্তিশালী সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন মোহাম্মদ দেইফ।
সূত্রটি বলেছে, “২০২১ পবিত্র রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েল হামলা চালানো, মুসল্লিদের পেটানো, মসজিদ থেকে বৃদ্ধ ও তরুণদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে দেওয়ার দৃশ্যগুলো সামন আসার পর এই হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
এসব কিছু সবার মনে ক্রোধ সৃষ্টি করে বলে যোগ করেছে সূত্রটি।
ওই সিদ্ধান্তের প্রায় দুই বছর পর ইসরায়েলের ভেতর ঢুকে হামাস ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছে। যে হামলায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। অপরদিকে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯৫০ মানুষ।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মোহাম্মদ দেইফকে হত্যা করতে সাতবার চেষ্টা চালিয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। যার সর্বশেষটি ছিল ২০২১ সালে। দেইফ খুব বেশি কথা বলেন না বা জনসম্মুখে আসেন না। যখন গত শনিবার হামাস টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, মোহাম্মদ দেইফ কথা বলবেন— তখনই ফিলিস্তিনিরা বুঝে যান বিশেষ কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
অবশ্য ওইদিন দেইফ কথা বললেও সরাসরি তিনি টিভি পর্দায় উপস্থিত হননি। এর বদলে তার ছায়া দেখানো হয়। সব মিলিয়ে দেইফের মাত্র তিনটি ছবিই রয়েছে।
দুটি ব্রেন, একজন মাস্টারমাইন্ড
হামাসের ওই সূত্রটি জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলার সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নেন হামাসের আল-কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ও হামাস গাজা শাখার অপর নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তবে এটি পরিষ্কার এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী কে?
সূত্রটি জানায়, “সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ছিল দুটি ব্রেন, কিন্তু সেখানে ছিল একজন মাস্টারমাইন্ড। ইসরায়েলে হামলা চালানোর ব্যাপারে মাত্র কয়েকজন কমান্ডার জানতেন।”
এই সূত্রটি আরো জানিয়েছে, হামলার ক্ষেত্রে খুবই গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছিল। ইরান জানতো যে হামাস এ ধরনের একটি অভিযানের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এই অভিযান কখন শুরু করা হবে সেটি জানতো না তারা।
কে এই মোহাম্মদ দেইফ?
মোহাম্মদ দেইফের জন্ম হয় ১৯৬৫ সালে খান ইউনিসের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে। বাবা-মা তার নাম রাখেন মোহাম্মদ মাসরি। কিন্তু ১৯৮৭ সালে যখন ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয় এবং এতে তিনি যোগ দেন তখন তার নাম হয়ে যায় মোহাম্মদ দেইফ।
তিনি ১৯৮৯ সালে একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং ১৬ মাস কারাবরণ করেছিলেন।
মোহাম্মদ দেইফ গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানের উপর ডিগ্রি অর্জন করেন। যেখানে তিনি পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন।
মোহাম্মদ দেইফ হামাসের নেতৃত্ব পর্যায়ে আসার পর গাজায় বিভিন্ন সুড়ঙ্গ তৈরি করেন এবং হামাসের বোমা তৈরির সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক দশকে যত ইসরায়েলি আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন তার সবগুলোর পেছনে ছিলেন দেইফ। আর এ কারণে তিনি ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছেন।
হামাসের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলের একটি হত্যাচেষ্টায় মোহাম্মদ দেইফ একটি চোখ ও পা হারান। ২০১৪ সালে ইসরায়েলের বিমান হামলায় তার স্ত্রী, সাত মাস বয়সী ছেলে ও তিন বছর বয়সী মেয়ে প্রাণ হারায়।
ইসরায়েলের এজেন্টদের কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য মোহাম্মদ দেইফ স্মার্টফোনসহ কোনো ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।