পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গতকাল মঙ্গলবার গ্রেপ্তারের পরই দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ইন্টারনেট ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। দেশজুড়ে মোবাইল ফোন পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সমর্থকদের অবরোধের কারণে পুরো দেশই কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। কোয়েটা শহরে পুলিশের গুলিতে ইমরানের এক সমর্থক নিহত হয়েছে।
ইমরানের আইনজীবী ব্যারিস্টার আলী গোহার অভিযোগ করেন, গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁর (ইমরান) মাথায় আঘাত করেন রেঞ্জারস সদস্যরা এবং তিনি পায়ে ব্যথা পেয়েছেন।পাকিস্তানের গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ইমরানকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় তাঁর সমর্থকরা রাস্তায় বের হয়ে এলে বেলুচিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। প্রদেশটির কোয়েটায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের এক কর্মী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ছয়জন। ইমরান সমর্থকরা শহরের বিমানবন্দর অভিমুখী সড়ক অবরোধ করে। সেখানকার ক্যান্টনমেন্টের সামনে পিটিআইকর্মীদের বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাদেশিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, পিটিআইয়ের জমায়েতে গুলি ছোড়া হয়েছে। দেশজুড়ে হতাহতের বিস্তারিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
ফয়সালাবাদ, মুলতান, পেশোয়ার, করাচি ও লাহোরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইমরানের সমর্থকরা।
ইমরান খান দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে গতকাল ইসলামাবাদের হাইকোর্টে হাজির হতে গেলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুারোর (এনএবি) একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশটির ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ার পরদিনই তিনি গ্রেপ্তার হলেন।
এনএবির চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) নাজির আহমাদ ভাট জানান, ইমরানকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেছে এনএবি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জারস এ পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে। আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়। উল্লেখ্য, এ মামলায় ইমরানের স্ত্রী বুশরাও আসামি।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেন, যথাযথ অভিযোগের ভিত্তিতেই ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি এ মামলায় হাজিরা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সম্প্রতি ইমরান খান অভিযোগ করেন, গত বছরের নভেম্বরে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তার নেপথ্যে ছিলেন সেনাবাহিনীতে চাকরিরত এক কর্মকর্তা। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার এবং ওই সেনা কর্মকর্তা তাঁকে হত্যা করতে চান। সোমবার এ অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ অভিহিত করে সেনাবাহিনী। এ ঘটনাকে সেনাবাহিনী ও ইমরানের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। অথচ ২০১৮ সালে ইমরান ক্ষমতায় আসার সময় জোরালো গুঞ্জন ছিল, সেনা সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় বসেছেন তিনি।
ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আহমেদ ফারুক গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিস্তারিত ‘ব্যাখ্যা’ চান। ঘটনা সম্পর্কে আদালতকে অবহিত করতে ইসলামাবাদের পুলিশপ্রধান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে ১৫ মিনিটের মধ্যে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট বিচারক। তবে এ নিয়ে পরে আদালত জানান, গ্রেপ্তারের ঘটনায় আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।
হাইকোর্টে দুটি মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য বের হওয়ার আগে গ্রেপ্তার সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন ইমরান। ওই সময় তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আমি গ্রেপ্তার হতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। আমাকে কারাগারে যেতে হলে আমি প্রস্তুত।’ গ্রেপ্তার হলে দল পরিচালনার জন্য কমিটিও গঠন করে দেন ইমরান।
পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো বলছে, গত বছরের এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরান খানের গ্রেপ্তার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ওই সময় কয়েকবার ইমরানকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হলেও সমর্থকদের বাধার মুখে তা সম্ভব হয়নি।
দেশব্যাপী বিভিন্ন শহরে ১৪৪ ধারা : ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করাকে কেন্দ্র করে গতকাল রাজধানী ইসলামাবাদে প্রথম ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, পুরো পাঞ্জাব শহরে আগামী দুই দিনের জন্য এবং খাইবারপাখতুনখোয়ার পেশোয়ার শহরে ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রধান শহরেও ১৪৪ ধারাসহ নানা কড়াকড়ি আরোপ করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।
দেশজুড়ে বিক্ষোভ : ইমরান খান গ্রেপ্তার হওয়ার পর পিটিআই দলের তরফ থেকে সমর্থকদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানানো হয়। পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মাহমুদ কোরেশি দলীয় প্রধানের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে পুরো জাতিকে অবিলম্বে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। দলটির অন্য নেতারাও জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। দলের চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনায় গঠিত ছয় সদস্যের কমিটি জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারা রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনি লড়াইও চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
আইনের শাসন অটুট রাখার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের : ইমরানকে গ্রেপ্তারে পাকিস্তানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দেশটিতে ‘আইনের শাসন অটুট’ রাখার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লোভারলিকে পাশে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা শুধু নিশ্চিত হতে চাই যে পাকিস্তানে যাই ঘটুক, তা যেন আইনের শাসনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।’ এ সময় ক্লোভারলি বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র দেখতে চাই। আমরা সেখানে আইনের শাসন দেখতে চাই।’