তিন বছর আগে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে শোনা একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেসময় ভ্লাদিমির পুতিন যাতে আরও ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে সংবিধানে আনা একটি পরিবর্তনকে সমর্থন করার জন্য রুশ নাগরিকদের প্রতি টিভিতে আহ্বান জানানো হচ্ছিল।
জনগণকে সমর্থনদানে উদ্বুদ্ধ করতে সংবাদ পাঠক প্রেসিডেন্ট পুতিনকে উপস্থাপন করেছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে। তিনি জানিয়েছিলেন, বিশ্বজুড়ে যে অসন্তোষের উত্তাল ঢেউ উঠেছে, তার মধ্যে দিয়ে রাশিয়াকে একটা স্থিতিশীল জাহাজের মত টেনে নিয়ে চলেছেন সুদক্ষ ক্যাপ্টেন পুতিন।
ওই সংবাদ পাঠক বলেছিলেন, ‘রাশিয়া স্থিতিশীলতার একটা মরুদ্যান, একটা নিরাপদ বন্দর। পুতিন না থাকলে আজ আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম?’ আজ কোথায় সেই স্থিতিশীলতার মরুদ্যান? কোথায় সেই নিরাপদ বন্দর? ২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০২২, ক্রেমলিনের সেই ক্যাপ্টেন তার নিজেরই তৈরি করা উত্তাল সাগরে জাহাজ ভাসিয়েছেন।
আর সেই জাহাজকে তিনি সোজা একটা হিমবাহের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন যে হিমবাহের ধাক্কায় তার জাহাজ চুরমার হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। ইউক্রেনের ওপর ভ্লাদিমির পুতিনের চালানো হামলা প্রতিবেশি দেশটিতে মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে এনেছে।
এমনকি তার নিজের দেশের সেনাবাহিনীতেও ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। কেউ কেউ অনুমান করে, হাজার হাজার রুশ সেনা এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। কয়েক লক্ষ রুশ নাগরিককে সে দেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে এবং রুশ বন্দিদের, এমনকি দোষী সাব্যস্ত সাজাপ্রাপ্তদেরও ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে।
ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের দামের ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। এছাড়াও এই যুদ্ধ ইউরোপ ও বিশ্ব নিরাপত্তার প্রতি হুমকি তৈরি করেছে। সবক্ষেত্রেই সমস্যার ব্যাপকতা টাইটানিক জাহাজের মতই বিশাল।
তাহলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কেন এই যুদ্ধে জড়ালেন? কেন ওই অঞ্চলে তার বিজয় পতাকা তুলতে তিনি এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একাতেরিনা শুলমান বলছেন: ‘২০২৪ সালে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসছে।’
একাতেরিনা শুলমান বলেন, ‘ওই নির্বাচনের দুই বছর আগে ক্রেমলিন চেয়েছিল কোন একটা বিজয়ের ঘটনা। তাদের লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালে সেই বিজয় অর্জন। তারা চেয়েছিল ২০২৩ সালে রুশদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিতে যে রুশদের ভাগ্য কত ভাল যে পুতিনের মত সুদক্ষ একজন ক্যাপ্টেন জাহাজের স্টিয়ারিং হুইল নিজের হাতে ধরে রেখেছিলেন।’
তিনি পুতিনের বিষয়ে আরও বলেন, ‘তিনি শুধু অসন্তোষের উত্তাল সমুদ্রই পাড়ি দেননি, তিনি তার জাহাজকে আরও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে গিয়ে নতুন এক বন্দরে সেই জাহাজ ভিড়িয়েছেন। এই কথার পর রুশ জনগণ তো তাকেই ভোট দেবে। ব্যস্! পাক্কা পরিকল্পনা। কোথাও ভুল হবার সুযোগ কি আছে?’
কিন্তু সুযোগ আছে অনেক, মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি বলছেন, ভুল হিসাব আর ভুল অনুমানের ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি করা হলে সে পরিকল্পনা সফল না হবার অনেক সুযোগই থেকে যায়। ক্রেমলিন আশা করেছিল, তাদের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বিদ্যুতগতিতে এগোবে।
তারা আশা করেছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়া ইউক্রেনকে কব্জা করে ফেলবে। ইউক্রেন যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এবং লড়াই করার ক্ষমতা দেখাবে, সেটা বুঝতে বড়রকমের ভুল করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি এটাও আন্দাজ করতে পারেননি যে কিয়েভকে সমর্থন জোগাতে পশ্চিমা দেশগুলো এতটা বদ্ধপরিকর হবে।
রুশ নেতা অবশ্যও এখনও এটা স্বীকার করতে নারাজ যে ইউক্রেন আক্রমণ করে তিনি ভুল করেছেন। পুতিনের পথ হলো এগিয়ে যাওয়া, আক্রমণের তীব্রতা বাড়ানো ও একই সঙ্গে আরও ঝুঁকি নেওয়া। এই পটভূমিতে দুটো প্রশ্ন এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, এক বছর পর পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন পুতিন? আর দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? এ সপ্তাহে পুতিন এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার বার্ষিক ভাষণের বেশিরভাগটা জুড়েই ছিল পশ্চিমের দেশগুলোর প্রতি তার বিষোদ্গার।
তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন আমেরিকা ও ন্যাটো জোটকে। তিনি জানিয়েছেন, এই যুদ্ধে রাশিয়া নির্দোষী ভূমিকা পালন করেছে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে নিউ স্টার্ট নামে যে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি হয়েছিল তার বাকি মেয়াদকাল পুরো করার আগেই রাশিয়ার এই চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত পুতিন ঘোষণা করেছেন, তা থেকে মনে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই যুদ্ধ বন্ধের কোন আকাঙ্ক্ষাই নেই অথবা পশ্চিমের সঙ্গে অচলাবস্থা নিরসনের কোন আগ্রহই তার নেই।
ওই ভাষণের পরদিন মস্কোর এক ফুটবল স্টেডিয়ামে পুতিন ইউক্রেনের সম্মুখ রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা রুশ সেনাদের সঙ্গে এক মঞ্চে উপস্থিত হন। ক্রেমলিনের সমর্থনে খুবই পরিকল্পনা মাফিক আয়োজন করা এক সমাবেশে জনতার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন জানান, রাশিয়ার ঐতিহাসিক সীমান্তে এই মুহূর্তে লড়াই চলছে এবং রাশিয়ার সাহসী যোদ্ধাদের তিনি প্রশংসা করেন।
ঐ ভাষণের উপসংহার ছিল এরকম: ক্রেমলিন তার লক্ষ্য পাল্টাবে এমনটা আশা করো না। এই রুশ প্রেসিডেন্ট তার লক্ষ্যে অটল। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আন্দ্রেই ইলারিওনফ মনে করেন, তাকে বাধা না দিলে, তিনি যতদূর যাওয়া সম্ভব যাবেন। সামরিকভাবে প্রতিহত করা ছাড়া অন্য কোনভাবে তাকে থামানো সম্ভব নয়।’
কিন্তু ট্যাংক নিয়ে আলোচনার কোন সুযোগ কি আছে? পুতিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা কি সম্ভব? আন্দ্রেই ইলারিওনফ বলছেন, ‘যে কারো সঙ্গে আলোচনায় বসা সম্ভব। পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসার ঐতিহাসিক রেকর্ডও রয়েছে এবং তার সঙ্গে নানা চুক্তিও হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, পুতিন সব নথিপত্র অগ্রাহ্য করেছেন। স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের জোট- কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটস্ গঠনের চুক্তি, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা সংক্রান্ত চুক্তি, জাতিসংঘ সনদ, ১৯৭৫এর হেলসিঙ্কি চুক্তি, বুদাপেস্ট সমঝোতা ইত্যাদি নানা চুক্তি। এমন কোন চুক্তি নেই যা তিনি ভঙ্গ করেননি।
যখনই চুক্তি ভাঙ্গার বিষয় এসেছে, রুশ কর্তৃপক্ষ পশ্চিমের বিরুদ্ধে তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশের লম্বা ফিরিস্তি হাজির করেছে। এই তালিকার শীর্ষে আছে মস্কোর বিশ্বাস যে ন্যাটো জোটকে পূর্বদিকে আরও সম্প্রসারিত না করার যে অঙ্গীকার ১৯৯০ সালে পশ্চিম করেছিল, তা তারা লংঘন করেছে।
অথচ, ক্ষমতায় বসার পর গোড়ার দিকে ভ্লাদিমির পুতিন ন্যাটোকে হুমকি বলে কার্যত দেখেননি। এমনকি ২০০০ সালে রাশিয়ার একদিন এই জোটের অংশ হওয়ার বিষয়টিও তিনি খারিজ করে দেননি।
কিন্তু দুই বছর পর ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করার বিষয় তার মতামত জানতে চাওয়া হলে প্রেসিডেন্ট পুতিন জবাব দিয়েছিলেন, ‘ইউক্রেন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং তার দেশের নিরাপত্তা তারা কীভাবে নিশ্চিত করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তাদের আছে।’
তিনি এমন কথাও জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এ বিষয়টি মস্কো ও কিয়েভের সম্পর্কের ওপর কোন ছায়া ফেলবে না। কিন্তু ২০২৩ সালের পুতিন খুবই ভিন্ন এক মানুষ। ‘পশ্চিমা জোটের’ বিরোধিতায় সোচ্চার পুতিন নিজেকে এখন তুলে ধরছেন অবরুদ্ধ এক দুর্গের নেতা হিসেবে।
রাশিয়ার শত্রুরা তার দেশকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে অভিযোগ তুলে তিনি বলছেন রাশিয়া তা প্রতিহত করছে। তার ভাষণ ও বক্তব্যে পিটার দ্য গ্রেট বা ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এর মত সাম্রাজ্যবাদী রুশ শাসকদের কথা তিনি যেভাবে উল্লেখ করছেন, তার থেকে মনে হয় পুতিন বিশ্বাস করেন, রুশ সাম্রাজ্যকে কোনো না কোনোভাবে আবার প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব তারই কাঁধে।
কিন্তু এর জন্য কী মূল্য দিতে হবে রাশিয়াকে? দেশে স্থিতিশীলতা আনার জন্য একসময় মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন পুতিন। কিন্তু সেনা অভিযানে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি, যুদ্ধে সেনা মোতায়েন এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার যাঁতাকলে পড়ে সেই জনপ্রিয়তা তিনি হারিয়েছেন।
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে কয়েক লক্ষ রাশিয়ান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এদের অধিকাংশই তরুণ, কর্মদক্ষ ও শিক্ষিত। এই মেধাশক্তি হারানোর ফলে রুশ অর্থনীতি আরও ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে। যুদ্ধের কারণে, হঠাৎ করেই সেখানে বন্দুকের শক্তি বেড়ে গেছে।
ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের ওয়াগনার সংস্থার মত ব্যক্তি মালিকানার বেশ কিছু সামরিক সংস্থা এবং আঞ্চলিক স্তরে নানা ব্যাটালিয়ান গড়ে উঠেছে। নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্পর্কও সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে বোঝা যায় ওপরের তলার মানুষদের মধ্যে কোন্দলের বিষয়টা এখন প্রকাশ্যে চলে আসছে।
একদিকে অস্থিতিশীলতা, অন্যদিকে বেসামরিক সেনাবাহিনীর উত্থান খুবই বিপজ্জনক একটা সংমিশ্রণ। মস্কো ভিত্তিক সংবাদপত্র নেজাভিসিমায়া গেজেটার মালিক ও সম্পাদক কনস্টানটিন রেমচুকফ বলছেন, ‘আগামী দশক জুড়ে রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ছে। বেশ কিছু স্বার্থসন্ধানী গোষ্ঠি তৈরি হয়ে গেছে যারা জানে যে এধরনের পরিস্থিতিতে সম্পদ ভাগ করে নেবার সুযোগ এসেছে।’
পুতিনের পর সঠিক কোনো নেতা ক্ষমতায় বসছেন কিনা তার ওপরই নির্ভর করছে গৃহযুদ্ধ এড়ানোর প্রকৃত সুযোগ আছে কিনা। এমন কোনো ব্যক্তির ক্ষমতায় আসা দরকার যিনি এই উপরের মহলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন এবং যারা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে মুখিয়ে আছে তাদের সরিয়ে দিতে তিনি কতটা বদ্ধপরিকর তার ওপরে।